ঠাকুমা ছাদে বড়ি দিয়েছে, খেসারীর আর মটর ডালের। সাদা বড়ি আর হলুদ বড়ি। বছরভর ঠাকুমার এটা একটা বড় কাজ। এমনিতে বুড়ি সারাদিনই কিছু না কিছু করে যাচ্ছে। ভোর চারটে উঠে কুয়োর জলে স্নান, শীত গ্রীষ্ম বিরাম নেই। গতবছর নিউমোনিয়াতে ভুগে বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী ছিলেন, একটু সুস্থ হতেই আবার আগের মত। জিজ্ঞেস করলে বলে, তাঁকে নাকি কোন এক সাহেব শিখিয়েছিল, Early to Bed n Early to Rise; Makes a Man Healthy Wealthy n Wise. ঠাকুমা তো woman ছিল, তাই healthy আর wealthy হতে পারে নি ।
Wise তো ঠাকুমা ছিল। নিউমোনিয়ায় শুয়ে শুয়ে আমায় গোটা রামায়ণ এর গল্প শুনিয়েছে। ঠাকুরমার ঝুলি, ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর গল্প তো আমার তখনই শোনা। আমি যখন মহাভারত পাঠ করে শোনাতাম, ঠাকুমা আমায় বেশি করে বলতো কর্ণের কথা। সেই থেকে কর্ণ আমার প্রিয় চরিত্র। ঠাকুমা নাকি ছোটবেলায় এগুলো পড়েছিলো আর স্কুলে গেছিলো। তুমিও স্কুলে পড়াশোনা করতে নাকি? আমি তো অবাক!
ঠাকুমার বাবা ছিলেন নামী উকিল। সবাই এক ডাকে চিনতো তাঁকে। জেলও খেটেছিলেন লুকিয়ে স্বদেশীদের সাহায্য করতে গিয়ে। জেলে গিয়ে খুলেছিলেন কয়েদীদের স্কুল। তিনিই উদ্যোগ নিয়ে ঠাকুমাকে পাঠিয়ে ছিলেন পাঠশালায়। গুরুমশাই এর দশ ছাত্রের মধ্যে ঠাকুমা একমাত্র মেয়ে। এর ফল ভুগতে হয়েছিলো তাঁকে। পসার কমতে থাকে, সমাজ তাঁকে একঘরে করার সব ব্যবস্থা করে। বাড়িতে শিক্ষক রেখে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন, যাতে দুই ছেলের সাথে মেয়েও শিক্ষার আলো পায়। অত্যধিক মানসিক যন্ত্রণায় খুব তাড়াতাড়ি তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার আগে মেয়েকে তুলে দিয়ে যান দাদুর হাতে। ঠাকুমার নবজন্ম হল বিয়ের পর। সে আর এক গল্প।
আমি ফিরে আসি ছাদে। বড়ি শুকাচ্ছে ছাদে। ফুল পাতা নক্সা করা কাঁসার থালার ওপর ধবধবে সাদা কাপড় পেতে তার ওপর বড়ি দেওয়া। আগের রাতে ডাল ভিজিয়ে সকালে শিল নোড়াতে বাঁটা। ঠাকুমা কারিগর আর আমি এখানে পাহারাদার। কাক, চড়াই আর শালিখের হাত থেকে বাঁচাতে। পরিবর্তে পেতাম পাশের উঁচু ছাদে মজতে দেওয়া রকমারি আচার।
চাকুম চুকুম…… সুখানি চঃ