জীবনধারা – ৪

ঠাকুমার কাছে রাতে ঘুমানোর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ধাঁধা শোনা আর তার উত্তর খোঁজা। ফোকলা দাঁতে অদ্ভুত সুরে এখনকার ভাষায় One Liner –

‘ঝাড়ের মধ্যে থাইক্যা বাড়ালো টিয়া, লাল টুপিটা মাথায় দিয়া’
অথবা,
‘আল্লার কি সৃষ্টি, লাঠি ভরা মিষ্টি’

ওপার বাংলায় এরকম অনেক ‘মানে ধরা’ ছিল যেগুলোকে আমরা ধাঁধা বলি এখানে। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুম এসে যেত, সকাল হতে হাজার কাজের মাঝে ভুলে যাওয়াটাই ছিল নিয়ম। সেই সময়ের বৃত্তিধারী জলপানি পাওয়া এক মহিলার থেকে এরকম অনেক গল্প, ধাঁধা, প্রবাদ, প্রবচন শুনতে পাওয়া এক বিরল অভিজ্ঞতা বই কি! ছোটবেলাটা কোনোদিনই বোরিং হয় নি।

তখনও বাংলা ভাগ হয়নি, সিরাজগঞ্জকে দ্বিতীয় কলকাতা বলত সবাই। কলকাতার পরেই বন্দর শহর হিসেবে উঠে এসেছিল সিরাজগঞ্জ। কলকাতার সাথে রেল আর জলপথে ভালো যোগাযোগ ছিল বলে পাট ব্যবসার মানচিত্রে সিরাজগঞ্জ ছিল এক উল্লেখযোগ্য নাম। সংগৃহীত পাট এখান থেকে কলকাতা হয়ে চলে যেত ইংল্যান্ডে। অনেক জমিদার যুক্ত ছিল এখানে নোঙর করা জাহাজ কেন্দ্রিক ব্যবসায়। তেমনই এক জমিদার সিরাজ আলী চৌধুরী অনেকটা জমি দান করে এই বন্দরকে আরো বড় করেন। তার নামেই সিরাজগঞ্জ।

বাবার ঠাকুমা (হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন) গল্প বলে চলে – একবার বিশাল ভূমিকম্প হয় বাংলাদেশে। ব্রহ্মপুত্র নদী গতি পাল্টে যমুনা খাল দিয়ে বইতে শুরু করে যা পরে যমুনা নদী নাম নেয়। এরই পশ্চিম তীরে সিরাজগঞ্জ। সব বাড়ির মত আমাদেরও আম-জাম বাগান, বিঘার পর বিঘা চাষের জমি, ফুলের বাগান, মাছ ভর্তি পুকুর ছিল। আর ছিল নিজেদের নৌকা, ছোটো শহরগুলোর মধ্যে নদীপথে যাতায়াতের সেরা উপায়। নৌকায় চড়ে সদর থেকে জিনিসপত্র আনার সময়ে ঝড়ে নৌকা উল্টে যাওয়ার গল্প নাহয় পরে কোনও একদিন শোনানো যাবে।

বাবা – ঠাকুমারা ভাগ্যবান, সিরাজগঞ্জ এর মাটিতে পা পড়েছিলো সুভাষ বোস, মহাত্মা গাঁধী, জিন্নাহ, নজরুল আর আব্বাসউদ্দিনের বিভিন্ন সময়ে। আর রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেনই। বাংলাদেশে এলে স্থায়ী ভাবে থাকতেন শিলাইদহর কুঠি বাড়িতে আর কাছারি বাড়ি তো ছিল কাছেই, শাহজাদপুরে। পোষ্টমাস্টার, সমাপ্তি তো এখানে বসেই লেখা।

শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, রায়গঞ্জে আমাদের অনেক আত্মীয়-অনাত্মীয় থাকতেন, কেউ কাছের, কেউ বা দূর সম্পর্কের। আবার রক্তের সম্পর্কের কেউ না হয়েও সাহেব (ছব) আলী দেখাশোনা করতেন গোটা জমিদারি। দেশভাগের পরে সবাই এপার বাংলায় চলে আসার পরেও বাবার ‘আলী চাচা’ প্রতি বছর এসে দেখা করে যেতেন সবার সাথে। এই রকমই এক আত্মীয় ছিলেন কান্ত কবি রজনীকান্ত সেন। নজরুলের প্রিয় শহর সিরাজগঞ্জ সিনেমার দুনিয়াতেও ছাপ রেখে গেছিল কানন দেবী, পাহাড়ী সান্যাল, সুচিত্রা সেনের মাধ্যমে।

ঠাকুমার ঝুলি তখনও শেষ হয়নি, আপন মনে বুড়ি বলে চলেছে তার ছোটবেলার কত গল্প। সিরাজগঞ্জ থেকে বহরমপুর। উনিশ-কুড়ি শতকের সেসব মণিমুক্তো কি না কুড়িয়ে থাকা যায়?

আপাততঃ আমার মাথায় ঘুরছে নতুন বলা ধাঁধাটা –

‘ঘর আছে দুয়ার নাই, মানুষ আছে কথা নাই’

ঘুমও আসছে একটু একটু করে!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.