ডি ভি পালুস্কর

কলেজ জীবনে এক বন্ধু ছিল, অনেক বন্ধুর থেকে একদম আলাদা। আমি অন্ততঃ আর কাউকে এরকম পাইনি। শুভেন্দু থাকতো আমার বাড়ির কাছেই, তবে প্রথম যেদিন ওর বাড়িতে যাই সেদিন আমার সব গর্ব মাটিতে মিশে গেছিল। তার আগে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সংগ্রহ আমারই সেরা এরকম একটা প্রচ্ছন্ন অহংকার ছিল। সেই প্রথম একজনকে পেলাম যে বিষয়টা খুবই ভালোবাসে, দখলও আছে। মিলে গেলো দুজনে। বাড়িতে আসে এর পর, প্রতি রবিবার বাঁধা ছিল ওর আসা আর বিকেলে মুড়ি মাখা খাওয়া। আমি যেতাম সকালের দিকে। পাড়ার মধ্যে রান্নার বাটি চালাচালি হয় জানতাম কিন্তু আমাদের ছিল ক্যাসেটের আদান প্রদান। আমি বড়ে গোলাম আলী দিলে ও দিত আমির খান, আমার থেকে অজয় চক্রবর্তী নিয়ে তার বিনিময়ে দিত নিখিল ব্যানার্জি। আমার বাড়িতে সেই সময়ে এঁদের সাথে সুমন, নচিকেতা, শানু, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থাকলেও ওর বাড়িতে শুধুই আমজাদ আলী খান, জাকির হোসেন আর নিসার হুসেন খাঁ।

এভাবেই একদিন হাতে পেলাম পালুস্কর, ডি ভি পালুস্কর। নাম তো শুনেছি, গানও শুনেছি কিন্তু অল্প, রেডিওতে । সত্যি বলতে কি, ওনার গায়কী বাকিদের মত আকর্ষণ করেনি। ক্যাসেটটা তাও রাখলাম অঙ্ক করতে করতে শুনব বলে। কভারে অল্প বয়সী একটা ছেলে, কাশ্মীরী টুপি পরে – যদি না স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। পঁচিশ বছর কম সময় না।

ক্যাসেটটা ভজনের। এর আগে যুথিকা রায় আর সায়গলের গলায় ভজন শুনেছি আর শুনেছি মা’র সামনে বসে “মীরা কয় প্রভু…”। কেউ মারা গেলে “রঘুপতি রাঘব রাজা রাম”; বাড়িতে থাকা গাঁধী রচনাবলীতে পড়েছিলাম এটা নাকি গাঁধীজীর প্রিয় গান ছিল। এই প্রথম এর বাইরে কারুর গলায় ভজন শুনে কান খাড়া হয়ে উঠলো। আমাদের যৌবনে অরিজিনাল ক্যাসেট থেকে ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটে গান রেকর্ড করেনি এরকম কাউকে সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না। বেশ কিছু বন্ধুর ডাবল ডেক সিস্টেম ছিল সেটায় রেকর্ড হতো, না হলে দোকানে। পার্থ বলে একজনের কথা মনে পড়ছে যার audiocon দোকানে আমরা কত যে রেকর্ড করেছি তার হিসেব নেই, কুমার শানু থেকে লতা, আশা আবার বিসমিল্লাহ খান থেকে হেমন্ত, মান্না। এই ভজন এর ক্যাসেটটা আমি আর কপি করিনি, রেখে দিয়েছিলাম শুভেন্দুকে বলে। বিনিময়ে দিয়ে দিয়েছিলাম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এর সিনেমার গানের সংগ্রহ।

কি কি গান ছিল ওই ক্যাসেটে? কি কি ছিল না সেটাই প্রশ্ন। আজও মনে পড়ে ওই মিষ্টি মিহি গলায় গাওয়া গানগুলো – চলো মন গঙ্গা যমুনা, লছমন ধীরে চলো, থুমক চলত রামচন্দ্রা, পায়ো জী ম্যায়নে রাম রতন ধন পায়ো, রঘুপতি রাঘব রাজা রাম, আরো অনেক। সব মনে নেই এত বছর পরে।

মাত্র 34 বছর বয়সে মারা যান পালুস্কর। তার মধ্যেই নাম করে গেছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আর ভজনে। রক্ত কথা বলে, যোগ্য বাবার সুসন্তান। সুরদাস, তুলসীদাস, কবীর, নানক আর মীরাবাঈ এর ভজন মানেই তখন পালুস্কর। পরবর্তী কালে কুমার গন্ধর্ব, কিশোরী আমোনকর, সঞ্জীব অভয়ঙ্করদের ভজন শুনেও পালুস্করকে এগিয়ে রাখবো। ব্যক্তিগত মতামত, ভজনের জন্য ওনার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দিক অনেকটাই অবহেলিত ছিল। নাহলে আমির খানের সাথে বৈজু বাওরা সিনেমার ওই বিখ্যাত ডুয়েট “আজ গাওয়াত মন তেরো” (আর একটা দেশ রাগের মাইলস্টোন) কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এর সুরে শাপমোচনের একদম শুরুর সেই বিখ্যাত গান ” কালিয়ান সঙ্গ করত রঙ্গ রলিয়া” সবাই গাইতে পারতেন না। আরো কিছু গান শুনেছিলাম বিভিন্ন রাগের ওপর, এখন আর মনে নেই। বেঁচে থাকলে গ্বালিয়র ঘরাণার আরো ঝলক হয়তো শুনতে পেতাম আমরা সবাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.