ভাগ্যবানের ভাইফোঁটা

কথায় বলে, ঠকঠকালে হইবে কি, কপালে নেইকো ঘী। সার সত্যি কথা। তুমি যা চাইবে, সেটা পাবে না। যেটা বরং না হওয়াই ভালো, সেটা তোমার পেছন ছাড়বে না। কতো কতো উদাহরণ চাই বলুন দিকি? আমি নিজেই তো খান বিশেক দিতে পারবো, আপনারা সবাই এক জায়গায় হলে তো কথাই নেই।

এই বলে ঘটিগরম বাবু থামলেন। এ হেন আচরণ কেনো আর কিই বা এর পেছনে আছে জানতে গেলে একবার উঁকি মারতে হবে তেনার অন্দরে।

নামটা শুনে ভিড়মি খাচ্ছেন? ভাবছেন এই পাবলিক আবার কোত্থেকে উদয় হলো! আজ্ঞে, মহাশয়ের নাম ঘটিগরম নয়। মা বাবা এমন নাম রাখতে পারেন নাকি? কালু, বুড়ো, পটল, খ্যাদাঁ অব্দি ঠিক আছে, তাই বলে এরকম কিম্ভুত নাম? ব্যাকগ্রাউন্ডে মিউজিক হোক বা না হোক, আজ শুনে রাখুন ওনার আসল নাম! মা বাবা নাম রেখে ছিলেন লোচন, লোচন সরকার। না, পদ্ম বা ভীষ্ম – কোনো কিছুই না, শুধুই লোচন।

তা, এই লোচনের একবার খুব শখ হল যে ভাইফোঁটা নেবে। আগের বছর তার এক পিসতুতো দিদিকে দেখেছে অনেক দূরে গিয়ে এক ভাইকে ফোঁটা দিয়ে আসতে। সেবার থেকেই মাথার মধ্যে ঘুরছিল যে পরেরবার দিদিকে এত কষ্ট করতে হবে না। লোচন সকাল সকাল পাশেই দিদির বাড়ি গিয়ে ফোঁটা নিয়ে আসবে যাতে একটু বেলা করে বাবার সাথে যেতে পারে। ওই পিসি বাবাকে প্রতিবার ফোঁটা দেয় কিনা, সাথে লোচন ফাউ।

ভাইফোঁটার আগের দিন, লোচন বাবার কাছে বায়না করলো দিদির বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। কাল ফোঁটা, আজ গেলে নিশ্চয়ই মনে পড়ে যাবে ওদের। ঘুরে বেরিয়ে লুচি আলুর দম খেয়ে বাড়ি ফিরে আসা অব্দি হয়ে গেলো, তবুও পরের দিন সকালে ফোঁটা দেওয়ার কথা উঠলো না। মন খারাপ করে লোচন বাবার সাথে পরের দিন চলে গেলো। সেখানে অবশ্য ফোঁটা পেলো, সম্পর্কহীন অথচ দূরসম্পর্কের এক বোনের থেকে। সেই ফোঁটা চললো বেশ কয়েক বছর।

মাঝের বছর কুড়ি সবাই চুপচাপ – লোচন বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে সব কষ্ট বলতে নেই। যে কষ্ট কেউ নিজের থেকে বোঝে না, সেটা বলা আর লোকের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষে করা প্রায় এক। হঠাৎ বুড়ো বয়সে শোরগোল – লোচন ভাইফোঁটা পাবে। কি আনন্দ তার। সকাল সকাল বাজারে গিয়ে ভাল মাছ, পাঁঠার মাংস, মিষ্টি কিনে আনল। সাথে বোনের জন্যে ভালো ভালো উপহার। খুব খুশি সে, কত বছর পর বোন আসবে ফোঁটা দিতে। হোক না তার বয়স হয়েছে, ভাইফোঁটার আবার বয়স হয় নাকি!

পড়াশোনায় খুব একটা ভালো সে কোনদিনই ছিল না। সবচেয়ে অপছন্দের বিষয় ছিল সংস্কৃত। কি সব কঠিন শ্লোক, একটাও পুরোটা মনে থাকে না লোচনের। l ঐরকমই একটা কিছু ছিল – চক্রবত্ পরিবর্তনে, সুখানি চ দুখানি চ। সুখের দিন ভালই চলছিল, না পাওয়ার কষ্ট অনেক ফিকে হয়ে গেছে বেশ কয়েক বছর ধরে পেয়ে। পুজো এলেই লোচন দিন গোনে ভাইফোঁটার – ছুটি নিয়ে কবে কলকাতা যাবে।

একটু থামলো লোচন, এক নাগাড়ে অনেকক্ষণ বলে গেছে। বয়স থাবা বসিয়েছে শরীরে, সাথে নানান রকম অসুখ। ফের বলা শুরু করে লোচন – ওই দুখানি চ এর সময় শুরু হল সেবার থেকে। ছুটে ছুটে বাড়ি ফিরে শুনলাম বোন নাও আসতে পারে! বিশ্বাস করিনি, আশায় আশায় তাকিয়ে ছিলাম অনেকগুলো উপহারের দিকে। ওগুলো তো আনাই হয়েছে কালকের জন্য।

লোচন আমাদের দেখিয়েছে, ওই উপহারগুলো ওই ভাবেই রাখা আছে আলমারির একটা তাকে। সে আজও বিশ্বাস করে একদিন ওর বোন আবার আসবে ভাইফোঁটা দিতে – সেইদিন ওই উপহারগুলো সব তুলে দেবে ওর হাতে।

আহ্ মলো যা, ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেললাম যে বাবুরা। দেখেন দিকি, কি দিয়ে শুরু করেছিলাম আর কোথায় চলে এলাম। আচ্ছা, এতদূর যখন চলেই এলাম তাহলে আজ একটু জিরিয়ে নি – পরে নাহয় সুযোগ বুঝে একবার লোচন থেকে ঘটিগরম বাবু হওয়ার গল্পটা বলব!

আজ চলি, ক্যামন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.