শিক্ষক দিবস

কি শিখলাম এতোগুলো বছরে? ইতিহাস, ভূগোল যা পড়লাম, কাজে এলো না; গুগল আর জি পি এস এসে সব হাতের মুঠোয় এনে দিলো। বিজ্ঞানমনস্ক হয়েও দুহাতের পাঁচ আঙুলে আংটি, আর রাধার পূর্ব রাগ পড়ে পরকীয়ার লাইসেন্স পেলাম। ভাবুন তো একবার, সত্যি কি পেলাম?

বলবেন, স্কুলে যা পড়েছি সেগুলো কাজে লাগেনি, কলেজের calculus আজ probability এর নদীতে ভেসে গেছে, কেমিস্ট্রি ল্যাবে বানানো ফিটকিরি আজ আর গালে ঘষা হয় না। তাহলে শিখলে কি? কাজেই বা কি লাগালে! খ্যাপার পরশ পাথর ঢালু রাস্তায় গড়িয়ে যাচ্ছে, চেষ্টা করেও ধরা যাচ্ছে না। সবাই ছুটছে, ধাক্কা খাচ্ছে, গড়িয়ে পড়ছে কিন্তু সোনার হরিণ কই?

তাহলে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি উঠিয়ে দিন, গুরুমশাই এর তোলে xxx আবার পড়া শুরু করুন। ফিরে যান সেই যুগে যেখানে শুনে শুনে মনে রাখতে হতো, ছাপানো বই এর কথা যখন কেউ ভাবতে পারতো না, কিছু তালপাতার পুঁথি সম্বল। চেষ্টা করে দেখবেন নাকি? আগে তো দিব্যি std কোড সমেত আট সংখ্যার ফোন নম্বর মনে রাখতেন; এখন বুক ঠুকে তিনটে মোবাইল নম্বর মুখে মুখে বলতে পারবেন? এগুলোও তো একটা শিক্ষা, নাকি অন্য কিছু?

ভাবছেন, আজ শিক্ষক দিবসে এ কি হল? না কিছুই হয়নি। আমরা তথাকথিত ভদ্রলোকরা এগুলো ভাবি কিন্তু বলি না। মনের মধ্যে চেপে রাখি আর কেউ এগুলো বললে মনে মনে খুব খুশী হই। কিন্তু, ভেবে দেখুন তো, হাতে কি শুধু পেন্সিল রইলো? নাকি একটা সাদা কাগজও সাথে আছে?

কিসের শিক্ষা পেয়েছি আমরা? বছরের পর বছর কাগজ গিলেছি, পেট মোটা করেছি আর সময় মত উগরে দিয়েছি। এর নাম শিক্ষা তো? ভালো রেজাল্ট করে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে পাঁচ অঙ্কের মাইনে দিয়ে শুরু, একে একে গাড়ি, ফ্ল্যাট সব কিনেছি। তাও তো বাইশ তলার ফ্ল্যাট থেকে নোংরা প্লাস্টিকটা ছুড়ে ফেলি অনেক নিচের লিলিপুট বস্তিতে. দামী গাড়ি নিয়ে গেট দিয়ে বেরোবার সময়ে কাজের মেয়েটার ভাই এসে দাঁড়ালে না দেখার ভান করি, আবার আমরাই কোলে কুকুর নিয়ে ফার্স্ট ক্লাসে চড়ি। এ কেমন শিক্ষা যেখানে দুরকম ব্যবহার?

মা বাবা বলেছে বড় হতে হবে, তাই স্বার্থপর হয়েছি। বলেনি অন্যেরও ভালো করো, ভালো ভাবো তার। তাই তো lockdown এ দু’মাসের চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ তাড়াতাড়ি কিনে নিয়েছি। যদি না পাই – কে পেলো, কে পেলো না তাতে আমার কি? আগে তো আমি বাঁচি! চারপাশটা না থাকলে বাঁচবে কোথায় কাকা? শেখায় নি তো মা বাবা.

কিছু ডিগ্রি পেয়েছি, মানুষ হওয়ার শিক্ষা কোথায় পেলাম? দায়িত্ব এড়াতে বৃদ্ধাবাসের খোঁজ করি, মুখে বলি তোমরা আরো কত মানুষের সাথে থাকতে পারবে। আমরা একা থাকি, বুঝি একা থাকা কত কষ্ট। সেই শিক্ষাই তো পেয়েছি যেখানে রাতের বেশি হওয়া ভাত ডাস্টবিনে ফেলতে হাত কাঁপে না আমাদের। বাড়ির ঠিক পেছনের বাচ্চা ছেলেটা খেলো কিনা সেই শিক্ষা তো মা দেয়নি কোনোদিন. বাবা কি বলেছে রোজ যে খাবার বাঁচবে সেটা কুকুর বিড়ালকে দিও? কেউ কি শিখিয়েছে খাবার থালায় নিয়ে নষ্ট করা আর দিনের বেলা গোটা বাড়ি লাইট জ্বালিয়ে রাখা দুটোই একই অপচয়?

কি শিক্ষা পেয়েছি? কাকার ছেলে তোমার নিজের ভাই নয়, লাস্ট বয়ের সাথে আবার বন্ধুত্ব হয় নাকি? রকে বসে যে ছেলেগুলো আড্ডা মারে, তাদের দিকে তাকাতে নেই, চিনতে নেই তাদের যারা রাস্তার ক্রসিং এ বন্ধ কাঁচের জানালায় টোকা দেয়। বরং, এমন শিক্ষাই তো ভালো যেখানে রাতের বেলা গাড়ি নিয়ে নিয়ম ভেঙে চলবো রাস্তায়, অথবা এককথায় ছেড়ে দেবো তিন বছরের স্টেডি গার্লফ্রেন্ডকে। বলতে পারব ভুলে যাও যা হয়েছে, simply get lost.

কে দিলো এইসব শিক্ষা? মা? বাবা? আত্মীয় স্বজন? না শিক্ষক? নাকি এই সমাজ? ধিক্কার সেই শিক্ষাকে যে বাড়ি ফিরে ডালে নুন কম হয়েছে বলে বউকে পেটায়, লজ্জা সেই সমাজের যেখানে অন্যায়ের প্রতিবাদ টাকা দিয়ে বন্ধ করা হয়। সারা দিনে কত নারী কতবার লাঞ্ছিত হয়, তার হিসেব কে রাখে? গোটা সপ্তাহে কতজন একবেলা পেট ভরে খেতে পায়নি তার স্ট্যাটিসটিক্স কোথাও বেরোয় না, সারা মাস একটা ছেলে চাকরি খুঁজে না পেয়ে 100 দিনের লেবার হল, এই গল্প কোথাও ছাপা হয় না. কি লাভ তবে সেই শিক্ষায় যে শিক্ষা গতানুগতিক পথে চলতে শেখায় কিন্তু নতুন পথ তৈরি করতে বলে না?

এই শিক্ষা তো চাইনি আমরা। শিক্ষক দিবসে রাধাকৃষ্ণন এর ফটোতে মালা দেবো, আবেগঘন ভাবে স্বীকার করব মা বাবার অবদান, মনে করব স্কুলের স্যার ম্যাডামদের কথা – ব্যস দায়িত্ব শেষ! সেই শিক্ষাটাই তো পেলাম না, যেখানে মনের মধ্যে খিদে জমবে আরো অনেক কিছু জানার, সেই শিক্ষা আজও ভেতরে ঢুকলো না যেখানে মা বাবার অবদান নিয়ে নয়; তাদের ভালো লাগে এমন কিছু করা দরকার>> মাত্র একদিন শিক্ষকদের প্রশংসা না করে একটা গরিব ছেলের সারাবছরের পড়াশোনা করানোর দায়িত্ব নিলে বোধহয় শিক্ষাটা সম্পুর্ন হতো।

শ্রাদ্ধের সময়ে এক ঠাকুরমশাই বলেছিলেন, উনি মারা গেছেন কিন্তু বিলীন হয়ে যান নি। পার্থিব আর অপার্থিব জগতের মাঝে একটা সরু সুতোর ওপর দাঁড়িয়ে আছেন. শ্রাদ্ধ হল সেই আচার যেটা তাকে মুক্তি দেবে, বন্ধন মুক্ত হবেন চিরতরে। এই শিক্ষা তো আজও আমাদের ঘরে ঘরে। কোনো শিক্ষক দিবস সেই আগুনের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না। যেদিন পারবে, সেদিন বলব, কিছু শেখার চেষ্টা করেছি মাত্র।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.