আমাদের ছোটবেলায় পরীক্ষার জন্য জন্ম আর মৃত্যুর সাল তারিখ মনে রাখতে হত। আমার যেমন সিপাহী বিদ্রোহ আর পলাশীর যুদ্ধের সাল প্রায়শই উল্টে যেত। কিন্তু, মনিষীদের দিনক্ষণ কোনোদিন ভুলিনি। ঠিক যেমন ভুলিনি, ১২ই জানুয়ারি মানে স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন। বেশ মনে আছে, প্রথম যেদিন ক্লাস ফাইভে ভর্তি হলাম, স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী প্রকাশ আচার্য মহাশয়। বাবার সুবাদে সবাই তখন কাকু আর জেঠু – সবারই অবাধ যাতায়াত ছিল আমাদের বাড়িতে। এটা নিয়ে প্রথম জীবনে বেশ বিড়ম্বনার মধ্যে পড়েছিলাম, কাকে কি বলে ডাকব? বাইরে, বাড়িতে যেমন কাকু বলি সেটাই নাকি সবাই যেমন স্যার বলছে, সেটা। এ যেন অনেকটা সেই পরবর্তীকালে ডেল কার্নেগীর লেখা Where to Place Your Hands এর মত দশা। যাই হক, সবাইকে স্যার বলে ডেকে যাবতীয় আসুবিধা কাটিয়ে ক্লাস শুরু করেছিলাম। অনেক পরে, স্কুলে ভর্তির সেই কাগজে তারিখটা অস্পষ্ট হলেও পড়া যাচ্ছিল – ১২ই জানুয়ারী। ভর্তির সময় এত ছোট ছিলাম, হয়তো তাই মাথায় বিশেষ দিনের ব্যাপারটা আসেনি। কিন্তু, পরবর্তীকালে যখনই মনে পড়েছে, কেন জানি মনে হয়েছে আমার জীবনে ১২ই জানুয়ারি একটা বিশেষ দিন। পড়াশোনার প্রতি এত ভালোবাসার বীজ হয়তো ওইদিনেই পোঁতা হয়ে গেছিল।
আগে, যখন এই দিনটা বিবেক দিবস হিসেবে ধরা হত না, তখন প্রভাত ফেরির একটা চল ছিল। কোন কোন স্কুলের বা ক্লাবের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেত। প্ল্যাকার্ডে লেখা থাকতো স্বামীজির বাণী। ওদের মধ্যে যে একটু লম্বা, সুপুরুষ, তাকে গেরুয়া জামা পড়িয়ে বিবেকানন্দ সাজানো হত। রাস্তার ওপরে বাড়ি হওয়ার সুবাদে বেশ ভালই লাগতো দেখতে।
আমার বিবেকানন্দের সাথে পরিচয় যদিও বেশ আগেই। বাড়িতে আগে থেকেই ছিল ১২ খণ্ডের বিবেকানন্দ রচনাবলী। ভাষা বেশ কঠিন, তাই বেশ কয়েকবার বইগুলো হাতে নিয়েও পড়তে পারিনি। তবে কোন খণ্ডে কি আছে, সেটা সহজেই করায়াত্ত হয়ে গেছিল। পরবর্তীকালে বারবার কর্মযোগ, রাজযোগ পড়তে গিয়ে সেটা বেশ টের পেয়েছিলাম। বাড়িতে এমনি গীতা ছাড়াও মহাত্মা গান্ধীরও গীতার অনুবাদ আর টীকা ছিল; কোনদিনই সেটা ভাললাগেনি যতটা কর্মযোগ পরে ভাল লাগতো। তারও আগে চোখ পড়েছিল, দেওয়ালে টাঙ্গানো বিবেকানন্দের একটা ক্যালেন্ডার থেকে পাওয়া ছবি – সুন্দর করে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো। কি দৃপ্ত তার চাউনি, কি বলিষ্ঠ তার গঠন আর সুন্দর অথচ পুরুষালি মুখাবয়ব। ভালো না লেগে আর কোন উপায় ছিল না। আমার জীবনের প্রথম হিরো বিবেকানন্দ, নেতাজী নন।