জীবনধারা – ৫

ঠাকুমা ঘুম পাড়াতে পাড়াতে বলে চলে – এই সিরাজগঞ্জ ছিল শিল্প, সাহিত্য আর ঐতিহ্যের শহর। সেখানে ঈদও যেমন ধুমধাম করে পালন করা হতো, দূর্গাপুজোও সমান ভাবে জনপ্রিয় ছিল। সত্যিকারের কোনো ভাগ ছিল না হিন্দু আর মুসলমানের। কোনোদিন ভাবিনি যে সালমা আমার বাড়ির উঠোন ঝাঁট দেয় বলে তুলসীমঞ্চ অপবিত্র হয়ে গেলো। তোকে নিয়ে তো নৌকো করে শহরে যায় আলী ভাই, প্রাণ দিয়ে দেবে কিন্তু তোকে ছেড়ে আসবে না কোথাও।

মনে পড়লো সেই দিনটার কথা – আমি আর আলীচাচা নৌকো নিয়ে বেড়িয়েছি শহরের পথে। আমাদের নিজেদের নৌকোয় যাতায়াত করাই রেওয়াজ ছিল, একটু অবস্থাপন্ন যারা তাদের সবারই নৌকো থাকতো। শহর থেকে চিড়ে, মুড়ি এই সব নিয়ে ফিরছি। আলীচাচা দাঁড় টানছে আর আমি চুপটি করে বসে এদিক ওদিক দেখছি। একটু দেরি হয়ে গেছে আজ, অন্ধকার করে আসছে। আকাশে কালো মেঘও আছে, চাচা বলে এই মেঘ থেকে জোরে বৃষ্টি আসবে, আমাদের তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকতে হবে খোকাবাবু।কি করে বলে কে জানে! এই লোকটাই আবার উঠোনে বসে একের পর এক নারকোল ছাড়ায় আর আমাদের খেতে দেয় বা পুজোর জন্যে রেখে দেয়। কতবার আবদার করেছি ডাবের জল খাবো। গামছা গুটিয়ে নারকোল গাছে উঠে ডাব পেরে আনতো আমার জন্যে।

হটাৎ ঝড় এলো, এর পর আর কিছু মনে নেই । শুধু মনে আছে একহাতে নৌকোর দড়ি আর আর এক হাতে আমায় নিয়ে জল পেরিয়ে ডাঙায় উঠছে। পরে শুনেছিলাম নৌকো উল্টে গেছিলো আর আলী চাচা আমায় বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে যথারীতি। খাবারদাবার গুলো কি হলো কে জানে!

বাবা শুধু পুজোর সময়ে লম্বা ছুটি পেত বলে আলী চাচা আমায় নিয়ে যেত চড়কের মেলাতে অথবা মসজিদে আজান শোনাতে। চড়ক দেখে কেঁদে ফেলেছিলাম, ভেবেছিলাম ছেলেটা হয়তো মরেই যাবে – কিন্তু কিছুই হয়নি। ওই শলাকা বিঁধলেও কোন সাহসে ওরা এমন করে, ভেবেই পাই নি। সাহস তো আমার বাবারও ছিল। বিকেলে বেরিয়ে যেই দেখেছি পুকুরে পদ্ম না শালুক কি ফুটে আছে মাঝখানে, অমনি আবদার করেছি আমার চাই বলে। শীতের বিকেলে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে পদ্ম শালুক তুলে আনতে বাবার সময় লাগেনি, বিরক্ত ও হয়নি কোনোদিন। মা মরা এই ছেলেটার কোনো চাওয়া অপূর্ণ রাখবে না এই প্রতিজ্ঞা ছিল হয়তো। বাড়িতে ডাকাত পড়ার সেই ঘটনা তো আজও আমার চোখের সামনে ভাসে!

অনেক রাত হলো, ঠাকুমা বলে ঘুমিয়ে পর সোনা। কাল তোকে মেলার গল্প বলবো – স্নানের মেলা, বউ মেলা আর দই মেলা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.