আমার আবদারে স্নানের মেলা দিয়েই শুরু করতে হলো ঠাকুমাকে। জানি না কেউ কুম্ভস্নানের মতো করে কেউ এটা শুরু করে ছিল কিনা, কিন্তু হাজার হাজার পুরুষ নারী যেত এই স্নানের মেলায়। ঠাকুমাও নাকি অনেক বার গেছে। উল্লাপাড়ার কাছে করতোয়া নদীতে বসতো এই স্নানের মেলা। মা ঠাকুমাদের বিশ্বাস ছিল, এই এক দিন স্নান করলে সব অসুখ সেরে যায় – তাই এতো ভিড়! হিন্দু – মুসলমান কেউ বাদ যেত না আর সবাই কিছু না কিছু দান করতো সাধ্যমতো। দানের সেই চাল, ডাল, ডিম দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ানো হতো সবাইকে। একটা উৎসব উৎসব গন্ধ বাতাসে।
একে পূর্ববঙ্গ, তায় মেলা – এতো সংখ্যক হিন্দু এক জায়গায়, আর কোনো ঠাকুর থাকবে না সেটা আবার হয় নাকি? নিম বা বেল গাছের কাঠ দিয়ে তৈরী হতো এক ঠাকুর, যতদূর সম্ভব নাম ছিল ‘পাট ঠাকুর’। স্নানের শেষে দুধ, কলা, চাল – যে যেমন পারতো দান করতো। পরের দিন থেকে এই ঠাকুরকে বাড়ি বাড়ি নিয়ে গিয়ে আরো দান সংগ্রহ করা হতো। আবার এক বছর চলতো এভাবে। এটাই রেওয়াজ ছিল তখন।
আর ছিল বউ মেলা। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। চৈত্র মাসে উরস শরীফ হতো, পূর্ববঙ্গের অনেক মুসলিম আসতো এই সময়ে। কিন্তু শুধু পুরুষদের জন্যে ছিল এই মেলা,মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। তাই মেয়েদের জন্যে একটা গোটা মেলা। আলী চাচা তাই বাড়ির সবাইকে নিয়ে যেত এর পরের দিন বউমেলাতে. বাড়ির বউরাও মেলা থেকে যা যা প্রয়োজনীয় সেগুলো কিনতো – হাতা, খুন্তি, কড়াই সব।
তবে, ঠাকুমার কাছে সবচেয়ে বেশি নাম শুনেছি দই মেলার। বেশ কিছুতা দূরে ঈদগাহ এর মাঠে বসতো এই মেলা। দুশো বছরের পুরোনো এই দই মেলা বসতো আবার সরস্বতী পুজোর দিনেই। বাড়ির পুজো শেষ হয়ে গেলে সবাই মিলে যেত এই মেলায়। লোকে বলে, কোনো এক জমিদার তার বন্ধুদের জন্যে দই, চিড়ে, খৈ আর মুড়ি দিয়ে দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতেন – সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে। দই মেলা যখন, তখন দই তো পাওয়া যাবেই, দূর দূর থেকে সবাই দই বেচতে আসতো – কতরকম স্বাদের দই পাওয়া যেত মেলাতে। তবে শুধু দই নয়, ঠাকুমারা ধামা ভরে নিয়ে আসতো ক্ষীর, ক্ষীরসাপাত, খাসিয়ানা, মুড়কির মতো খাবার। ঠাকুমার গল্প বলার কায়দায় তখন আমি অন্য জগতে।