তবলা

মনমোহন সিংহের ভারতের অর্থমন্ত্রী হতে তখনও আরো দশ-বারো বছর বাকি, তার আগেই আমার বাড়িতে ছিল ওনার উদার অর্থনীতির মুক্ত পরিবেশ। মাধ্যমিক অবধি এতো কম পড়াশোনা দেখে অনেকেই আঁতকে উঠেছিল। সারা দিনের বেশিরভাগ সময় আমার কাটতো হয় গান শুনে না হয় তবলা বাজিয়ে কিংবা মাঠে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে। পড়াশোনার জন্য স্কুল বাদে বরাদ্দ ছিল সকালে এক ঘন্টা আর সন্ধেবেলা এক ঘন্টা। ক্লাস এইট অব্দি রাত নয়টায় ঘুমিয়ে পড়তাম আর মাধ্যমিকের বছরে সেটা বেড়ে হলো দশটা। তাও আবার পরীক্ষার আগের দিন পড়তে হতো না – ঘুরে বেরিয়ে, খবরের কাগজ পরে, বাড়িতে থাকা অজস্র গল্পের বই নাড়াচাড়া করতে করতেই কি করে যে দিন কেটে যেত বুঝতেই পারতাম না।

পড়াশোনা ছাড়াও যে অনেক কিছু করার আছে সেটা বাবা না থাকলে জানতে পারতাম না। সবাই যখন পড়ার বই মুখে নিয়ে বসে থাকতো, ততক্ষনে আমার ও হেনরির ছোট গল্পের বই পড়া শেষ হয়ে গেছে কিংবা ম্যাক্সিম গোর্কি। রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ তো আছেই সবসময়। গল্পের বই পড়া নিয়ে পরে আলাদা গল্প করবো, আজ অন্য কথায় আসি।

যেটা বলছিলাম, পড়াশোনা ছিল কম আর বাকি সব বেশি বেশি। খুব ছোট তখন, বয়স তিন কি চার। টিভিতে রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে (কে গাইছে মনে নেই) আর আমার চোখ গিয়ে পড়লো তবলাবাদকের দিকে। সুপুরুষ একজন, ঝাঁকড়া চুল, বাঁ হাতে তবলা আর ডান হাতে বাঁয়া নিয়ে সঙ্গত করছে। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় আমার অলিখিত গুরু হয়ে গেলেন সেদিন থেকে আর আমি তার কিছুদিনের মধ্যেই তবলা শিখতে শুরু করে দিলাম দাদুর বন্ধু আমার মাস্টারমশাই শ্রী বলরাম মুখোপাধ্যায় এর কাছে। প্রায় কুড়ি বছর তালিম নেওয়ার মধ্যে কোনোদিন মনে পরে না ওনাকে দাদু ছাড়া আর কোনো নামে ডেকেছি বলে। উনিও অনিলের নাতি, শুক্লার ছেলে বলে একটু বাড়তি ভালোবাসতেন সেটা অস্বীকার করি না। একটা ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল, মাকে দেখেছি ওনার সাথে বসে গান করতে, তাল-মাত্রার ভুল ত্রুটি সামলে নিতে। মা সেই রেডিওতে গাওয়ার সময় থেকেই ওনার সাথে বসতেন; তাই তার ছেলে বলে কিছু তো আলাদা খাতির ছিল।

আমি যে আলাদা সেটা বুঝতে পারি যখন দেখি বাকি যারা শিখছে তারা 1st Year, 2nd Year এর পরীক্ষা দিচ্ছে আর আমি শুধু শিখেই যাচ্ছি। একদিন মাস্টারমশাইকে একা পেয়ে কারণ জিজ্ঞেস করাতে বললেন – আগে দশ বছর শেখ, তার পরের আট বছর পরীক্ষা দিবি। সত্যি তাই হলো, সময়মতো সব হলো, কুড়ি বছর শেখার পর “সংগীত প্রভাকর” এর কাগজ পেলাম। ততদিনে বেশ কিছু জায়গায় বাজানো হয়ে গেছে, কলেজের ওয়েলকাম অনুষ্ঠানে গানের সাথে বাজিয়েও ফেলেছি হটাৎ করে। যদিও প্রথম অনুষ্ঠানের স্মৃতি খুব কষ্টের আমার কাছে। বেশ ছোট তখন, রংমহলের স্টেজে তবলা লহরা বাজিয়েছিলাম, হারমোনিয়ামে সা টিপে ধরে ছিলেন মাস্টারমশাই আর তার কিছুদিন পরেই আগুন লেগে পুড়ে যায় রংমহল থিয়েটার। আজও সেই পোড়া হল অতীতের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

শেষ বছর পরীক্ষায় বসে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা হলো। একজন বৃদ্ধ মানুষ এসেছেন পরীক্ষক হয়ে, সবাই বলাবলি করছে খুব কড়া ধাতের মানুষ; খুব কঠিন কঠিন বোল বাজাতে বলছেন আর তার সাথে অনেক কিছু জিজ্ঞেসও করছেন। আমার পালা এলো, মাস্টারমশাই আলাপ করিয়ে দিলেন অনিলের নাতি বলে। তার প্রথম প্রশ্ন, তুই শুক্লার ছেলে? জানা গেলো আমার দাদুর বেহালার সাথে উনি তবলা সঙ্গত করতেন অনেক প্রোগ্রামে আর মাকে জন্মাতে দেখেছেন | পৃথিবী যে অনেক ছোট সেদিনই বুঝে গেছিলাম |

দাদুর কাছে অনেক গল্প শুনে বড়ো হয়েছি – বিখ্যাত গাইয়েদের জীবন, বংশধারা, ঘরানা, আরো কত কিছু। সেখানেই প্রথম শুনি সবার নাম আর তবলা শিখছি বলে একে একে সব দিক্পালদের গল্প বলতো দাদু। একটা বই ছিল, খবরের কাগজ দিয়ে মলাট দেওয়া। অনেক মনীষীদের জীবনী ছিল সেটায়, গোগ্রাসে গিলতাম সেই সব। জীবনের প্রথম বাইবেল ওটাই আমার।

তবলা সম্পর্কে যারা একটু উৎসাহী তাদের জন্য বলি, প্রথমে মৃদঙ্গ, তারপর পাখোয়াজ আর সবশেষে আসে তবলা। খোল বা মৃদঙ্গ (একটু আলাদা) ব্যবহৃত হত সেই ভক্তিবাদের সময় থেকে, শ্রীচৈতন্যদেবের খোল করতাল সহযোগে নৃত্যরত নগর সংকীর্তনের ছবি আমরা অনেকেই দেখেছি। পাখোয়াজ বাজানো হতো ধ্রুপদ গানের সাথে, ওর গম্ভীর আওয়াজ একদম মানানসই ছিল ধ্রুপদের সাথে। তবলার আবির্ভাব প্রায় 200 বছর আগে, দিল্লীর রাজ দরবারে। গানের মতো তবলাতেও বিভিন্ন ঘরানা আছে – দিল্লী ঘরানা , লখনৌ ঘরানা , আরজারা ঘরানা , ফারুখাবাদ ঘরানা , পাঞ্জাব ঘরানা আর বেনারস ঘরানা । বিভিন্ন তাল যেমন তিনতাল, একতাল, ঝাঁপতাল, দাদরা, কাহারবা, অথবা লয়, মাত্রা এক থাকলেও বিভিন্ন বোলের রকমফের দেখা যায় এই ঘরানাশৈলীর পেশকার, কায়দা, টুকরা, মুখরা, উঠান আর রেলাতে। এই সব ঘরানারই দিকপাল শিল্পীরা হলেন কাল্লু খাঁ, ঘাসিত খাঁ, নিখিল ঘোষ, মুনীর খাঁ, বাকসু খাঁ, আহমেদজান থেরকুয়া, নাথু খাঁ, সাবির খাঁ, কন্ঠে মহারাজ, সামতা প্রসাদ, কিষান মহারাজ, আল্লারাখা, কেরামাতুল্লাহ খাঁ, শংকর ঘোষ, গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ প্রমুখ। পরবর্তীতে এদেরই হাত ধরে জাকির হুসেন, বিক্রম ঘোষ, তন্ময় বোস, স্বপন চৌধুরী, অনিন্দ্য চ্যাটার্জি, কুমার বোসের মতো শিল্পীরা ক্রমশঃ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তবলাকে বিশ্বের দরবারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.