ভাড়া বাড়ি – ৪

বরাহনগরের বাড়িটার আর একটা বড় আকর্ষন ছিল লম্বা একটা ছাদ। ঘুড়ি ওড়ানো থেকে রাস্তা দিয়ে যাওয়া মিছিল, পয়লা বৈশাখের প্রভাত ফেরি থেকে ঠাকুর ভাসান – অনেক কিছুর সাক্ষী ওই ছাদ। ছাদ লাগোয়া ঘরে আমি থাকতাম একটু বড় হতে, বেশ মানিয়ে নিয়েছিলাম একা একা থাকা। রাতে কেঁপে উঠতো গোটা বাড়ি, ভারী লরি যেতো ওই রাস্তায়। ওই আওয়াজের ছন্দে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম কে জানে!

তিনতলা এই বাড়িতে কোনো জল ছিল না। হয় রাস্তার ওপার থেকে কল থেকে জল ভরে নিয়ে আসো অথবা ভারীদের ওপর ভরসা করো। প্রথমে কুলমনি পরে গুরুশরণ জল দিয়ে গেছে সারাজীবন। ছুটি নিলে আগে বাবা আর পরে আমি জল নিয়ে আসতাম ক্যানে করে। অনেক বলেও বাড়িতে জল আনা যায়নি। শেষের দিকে কোনো এক (অ)জানা কারণে রাত নয়টার মধ্যেই সদর দরজা বন্ধ হয়ে যেতো। এত কিছু সত্ত্বেও একটা অদ্ভুত টান অনুভব করতাম ওই বাড়ির ওপর।

ভাড়া বাড়ির গল্প শেষ করব এবার একটা মজার ঘটনা বলে। আশির দশকে বরাহনগরে আফিম খাওয়ার একটা চল ছিল। আমাদের সামনের দোকানে এক দাদু (তুফান কাকুর পাশের দোকান, সম্ভবত মণি দাদু) বসত, সে সাথে আরো কয়েকজন প্রতি সন্ধেতে আফিমের গুলি খেয়ে ঝিম ধরে বসে থাকতো। এঁদের মধ্যে আমাদের বাড়ির নিচের একজনও ছিলেন, অবিবাহিত এই মানুষটিকে আমরা ঝনঝন দাদু বলতাম। নামের তাৎপর্য আজ আর মনে নেই, বয়স্ক দিদির সাথে থাকতেন। একটু খিটখিটে ছিলেন, কিন্তু আমায় বেশ ভালোবাসতেন, হয়তো জন্মাতে দেখেছেন বলেই। বিকেল হলেই এঁদের মত বয়স্কদের আড্ডার জায়গা ছিল কিছু নির্দিষ্ট দোকান যেখানে আফিম খেয়ে ঝিম ধরে বসে থাকা যেত। ঠিক তেমনি একটা নির্দিষ্ট পান বিড়ি সিগারেট এর দোকানে বসে থাকতো আর এক কাকু। সারা দিন-রাত ওখানেই আড্ডা মারেন আর ঘুমাতে যান পাশের পুলিশ কোয়ার্টারে । একবার বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কাকু অফিস যান না, বাবা উত্তর দিয়েছিলেন ওটাই ওনার অফিস। পরে বড় হয়ে জেনেছিলাম সাদা পোশাকের পুলিশ কাকে বলে আর তাদের কি কি কাজ থাকে। অনেক রাত হলে নির্জন রকে বসত সাট্টার ঠেক, পেন্সিলাররা বাজি ধরতো বিভিন্ন বিষয়ে। লেগে গেলে টাকা তার, নাহলে গেল। কাকুর কাজ ছিল এই সব ঠেকের ওপর নজর রাখা।

সাট্টার কিছু কোড আমিও তখন জানতাম, যারা খেলতো তাদেরকেও চিনতাম। তাদের খেলতে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম এখানে বসা পেন্সিলারদের ওপরে আছে এজেন্ট আর তাদের মাথায় বসে আছে বুকি। সাট্টা ছিল সংখ্যার বাজি, একটা কাগজে নম্বর লিখতে হতো – সেটা মিলে গেলেই কেল্লা ফতে। জেতার অঙ্কও মন্দ ছিল না, 1 টাকার পরিবর্তে 10 টাকা! আশির দশকে দশ টাকার যথেষ্ট দাম ছিল। এই নম্বরের আবার অনেক রকম কায়দা ছিল – কেউ তিন সখ্যার একটা সংখ্যা বলত, তার প্রত্যেকটা যোগ করলে যে সংখ্যা বেরোতো সেটার ওপর বাজি রাখা হতো। আবার তিন সখ্যার শেষ নম্বর দিয়েও বাজি খেলা হত। ধরা যাক কেউ বললো 463 এই নম্বর। এবার 4+6+3=13=1+3=4 এভাবে কেউ খেলতো আবার কেউ 463 এর শেষ তিন ডিজিট ধরে খেলতো। এটা ঠিক করত পেন্সিলার। এবার এই 4 বা 3 যেটা ঠিক হবে সেটা মেলাতে হবে। কি করে মিলবে? খুব সোজা একটা রাস্তা বের করেছিলো – এর পরের যে লরি আসবে তার চারটে সংখ্যার মধ্যে বা প্রথম দুটো বা শেষ দুটো বা একদম প্রথম বা একদম শেষের সংখ্যার সাথে ওই 3 বা 4 নম্বরটা মিলতে হবে। খুব ইন্টারেস্টিং খেলা, নেশা হতে বাধ্য আর রেজাল্ট কারুর হাতে নেই। তবু সাট্টার ঠেকে হাতাহাতি ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। টাকা পয়সা ভাগ নিয়েই সমস্যা হতো বেশি। ফল, পুলিশের গাড়ি করে সোজা থানা। এই সাট্টাই পরে অনেক ভাবে বারবার ফিরে এসেছে, সে মুম্বই এ মটকাই হোক বা অনলাইনে সুপার লোটো কিংবা ক্রিকেটের বেটিং চক্র। সবগুলোরই ভিত কিন্তু এই সাট্টা।

সবচেয়ে আশ্চর্যের হল, ছোটো থেকে বড় হওয়ার এই সময়ে কখনো মা – বাবার থেকে শুনি নি এটা করো না, ওখানে যেও না, ওর সাথে মেলামেশা করো না। তাই সবার সাথে নির্দ্বিধায় মিশে যেতে পেরেছি, খারাপ ছেলে তো কেউ বলেনি। আরো অনেক কিছু এলোমেলো ভাবে ভিড় করে আসে, তবে সব লেখার উপাদান থাকে না। লোকাল পকেটমারদের সাথে সখ্যতা নিয়ে তো আগেই লিখেছি, বাবার বরাহনগরের জীবনের অনেক ঘটনা জড়িয়ে ছিল সত্তরের দশকের নকশাল আন্দোলনকে ঘিরে। সেগুলো নিয়ে নাহয় অন্য একদিন বসা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.