ভাড়া বাড়ি – ২

সকাল শুরু হতো পাশের হরিণঘাটা ডিপো থেকে বোতলের দুধ এনে, যদিও তারও আগে মাঝরাতে রাতজাগা পার্টির লাইট পোস্টে লাঠির বাড়ি দিয়ে সেই “জাগতে রহ” বলে ডাক ঘুম ভাঙিয়ে দিত। চোরেদের ঘুম এমনিতেই উড়ে গেছিল যদিও আমাদের কোনোদিন কোনো কিছু চুরি হয়নি। এদিক ওদিক থেকে খবর আসতো লোডশেডিং এর সময়ে চুরির ঘটনা। চোরেদের নিয়ে বাবার আর আমার দুজনেরই অনেক অভিজ্ঞতা আছে, ওটা আলাদা করে বলব কোনো এক দিন। খুব সকালে দুধের গাড়ি থেকে কাঁচের বোতলের ক্রেট নামতো শশব্দে, ওটাই ছিল আমার ঘুম ভাঙার অ্যালার্ম। বাজারে মাছের জন্যে ছিল পরেশ কাকু, মন্টু কাকু, আর এক বুড়ি যে শুধু চারাপোনা আর বাটা মাছ আনতো। সবজি র নীলমনি আর আলু পেঁয়াজের জন্যে কর্তা (এরকম নাম কেন জানি না)। এরা আমায় জন্মাতে দেখেছে, বাবার হাত ধরে বাজারে আসতে দেখেছে তাই পরে একা বাজার করতে গিয়েও কোনোদিন কোনো অসুবিধা হয়নি। মাংস রান্না করতে গিয়ে হয়তো দেখা গেলো রসুন নেই, আমি একটা শার্ট আর হাফ প্যান্ট পরে রাস্তা পেরিয়ে চললাম কর্তার কাছে। রসুন দিলো, দাম নিলো, সাথে এক টুকরো আদা দিয়ে বললো এটাও নিয়ে যাও খোকাবাবু, যদি লাগে আবার তো আসতে হবে তোমায়। ওটার জন্য যে আবার আলাদা করে দাম দিতে হবে সেই বোধ তখনও হয়নি। জানলায় দাঁড়িয়ে থাকা সজাগ দৃষ্টির বাবার চোখ এড়াতো না, পরের দিন কর্তাকে টাকা দিতে গেলেই বাবা শুনতো – ও তো আমি বাবুকে এমনি দিয়েছি দাদা, কি আর আমি দিতে পারি! শুনেছি, এই কর্তার একবার খুব শরীর খারাপ হলে বাবা নাকি চিকিৎসার খরচ দিয়েছিল। হাঁপানির অসুখে মাঝে মাঝেই ভোগা বয়স্ক কর্তা সেটা মনে রেখেছিল সারাজীবন।

রোজ বাজার যাওয়া হতো বলে ওখানেই সাইকেলের ওপর দাঁড়িয়ে কাগজ বিক্রি করার কাকুর থেকে বাবা কাগজ আনতেন বাড়িতে। দুই ভাই ছিল ওরা, এক ভাই সকালে উঠে কাগজ নিয়ে বাড়ি বাড়ি দিয়ে আসতো আর ছোটো ভাই বাজারে এসে দাঁড়াতো। আমার আলাপ বেশি ছিল ছোটো ভাই এর সাথে। এর আগে এক জায়গায় লিখেছিলাম, জন্মের পর প্রথম দেখি বই, আর প্রথম শুনি গান। খবরের কাগজের কথা বলা হয়নি। জন্ম ইস্তক বাড়িতে রোজ আনন্দবাজার আর রবিবার সাথে স্টেটসম্যান দেখে এসেছি, কোনোদিন নড়চড় হয়নি। প্রথম ম্যাগাজিন পড়ি দেশ, একে একে আনন্দমেলা, শুকতারা পূজাবার্ষিকীও নেওয়া হতো ওই কাকুর থেকেই। কেন জানি না একটা ম্যাগাজিন ছোটবেলায় কোনোদিন ঢোকেনি বাড়িতে, আনন্দলোক; অথচ অনেকেই কিনে নিয়ে যেতো। সকালে খবরের কাগজ বাবা নিয়ে এলেই প্রথম পাঠক ছিলাম আমি। বাজারের ব্যাগ রেখে হাত মুখ ধুয়ে যখন বাবা জলখাবার খেতে বসত তার মধ্যেই আমার কাগজের চোখ বোলানো শেষ। কে বলে ছোটবেলায় কোনো টার্গেট থাকে না? ঐটুকু সময়ে প্রথমে খেলার পাতা, তারপর ভেতরের পাতা, শেষে প্রথম পাতা চোখ বুলিয়ে নেওয়া। বিস্তারিত পরে পড়া যাবে। সেই অভ্যেস এখনও আছে, আজও প্রথমে শেষ পাতা পড়ি, তারপর এক এক করে প্রথম পাতায় আসি।

বাবার সাথে এই খবরের কাগজের যুদ্ধ বহুদিন চলেছে। কিছুটা সমাধান হল 1987 Reliance World Cup ক্রিকেট এর সময়ে । স্টেটসম্যান এর কঠিন ইংরেজি পেরিয়ে সেই প্রথম একটা কাগজ পেলাম যেটা সহজ ইংলিশে লেখে। শুধু খেলাই বুঝতাম তখনও, তাই গাভাস্কার, বেঙ্গসরকারদের কলাম প্রথম পড়তে চেষ্টা করলাম টেলিগ্রাফের পাতায়। আমার ইংরেজি শেখার চারটে পিলার – বাবা, টেলিগ্রাফ, টিভি আর পরে নিজে নিজে। এর মধ্যে লেখার ভিত তৈরি করে দিয়েছিল টেলিগ্রাফ। আর বাবার শেখানোর পদ্ধতিও ছিল অসাধারণ, প্রথমে খেলার পাতায় ছবির নিচে ক্যাপশন পড়তে দিয়েছিলো, তার পর হেডিং আর সবশেষে ভেতরের বিষয়। মনে পড়ে না ছোটবেলায় আর কোনো পাতায় কোনো খবর পড়তাম বলে। আগের দিনের রেডিওতে শোনা বা টিভিতে দেখা খেলা মিলিয়ে নিতাম টেলিগ্রাফের পাতায়। এভাবেই ইংরেজি শেখার শুরু। তখনই বেরোতো দুটো খুব পপুলার খেলার ম্যাগাজিন – স্পোর্টস্টার আর স্পোর্টসওয়ার্ল্ড। খেলা আর খেলার দুনিয়া বলে বাংলা কিছু ম্যাগাজিনও ছিল, কিন্তু ওই ইংরেজী ম্যাগাজিন দুটোর প্রধান আকর্ষণ ছিল ঠিক মাঝের দুটো পাতা জুড়ে কারুর ছবি। সাধারণত সিনেমা আর্টিস্টদের ছবি জমানো বা দেওয়ালে অথবা দরজার পেছনে আটকানোর রেওয়াজ দেখা যায়, কিন্তু আমার কলেকশনে একে একে জমে উঠেছিলো স্টেফি গ্রাফ, গাব্রিয়েলা সাবাতিনি, মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা, আন্দ্রে আগাসি, বরিস বেকার, কপিল দেব, সানি গাভাস্কার, আরো অনেকে। ম্যাগাজিনের কথা যখন চলেই এলো, তাহলে চুপিচুপি বলে রাখি – প্রতি রবিবার টেলিগ্রাফের ম্যাগাজিনে রথীন মিত্র সাহেব কলকাতার কোনও বিখ্যাত বিল্ডিং এর রেখাচিত্র আঁকতেন। এতো সূক্ষ্য ডিটেইলিং যারা দেখেননি তাদের বলে বোঝানো যাবে না। এখন বই আকারেও পাওয়া যায়। সেই পাতাগুলো ছিড়ে ছিড়ে একটা মোটা বইয়ের মধ্যে জমিয়ে রাখতাম, ওটা ছিল আমার কালেকশন। বই, কাগজ, ম্যাগাজিন পড়া একটা নেশা, সেটা বেশ ভালো বুঝতাম মাকে দেখে। দুপুরে খেয়ে উঠে মা’র একদম মাস্ট ছিল খবরের কাগজ পড়া। পড়তে পড়তে হয়তো ঘুম এসে যেতো, দিনের শেষে আক্ষেপের পাহাড় জমা হতো অনেক কিছু পড়া হলো না বলে, কিন্তু পড়ার নেশায় কোনো খামতি ছিল না. আজও সেই ট্রেডিশন সমানে চলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.