ভাড়া বাড়ি – ৩

বরাহনগরের কথা বলতে বসলে একে একে অনেক কিছু ভিড় করে আসে। মনে পড়ে ভাই বোন, টুনটুন, দুলুদাদের অমায়িক ব্যবহার – দোকানে জিনিস কিনতে গেলেও যে একটা সম্পর্ক তৈরি হয় এরা তার প্রমাণ। আজও ভুলতে পারিনি ইলেকট্রিক এর সেই দোকানের মালিককে যে বাবার রিটায়ারমেন্ট এর দশ বছর আগে থেকেই দোকানে গেলে জিজ্ঞেস করতেন, মাস্টারমশাই আপনি retire করে গেছেন? ভুলতে পারিনা বাড়ির নিচে রবি কাকুর সেই বিখ্যাত ইউনিক টেলার্স, ওখান থেকে চলে এসেও যার কাছে জামা প্যান্ট বানিয়েছি। খুব ধুমধাম করে বক্স বাজিয়ে অক্ষয় তৃতীয়া করত, প্রথম প্রথম গিয়ে রঙিন শরবত খেয়ে মিষ্টির প্যাকেট আর ক্যালেন্ডার নিয়ে আসতাম, পরের দিকে ভিড় বলে যেতে চাইতাম না। পরের দিন ঠিক সকালে বাড়িতে ক্যালেন্ডার আর মিষ্টি চলে আসতো। কোনোবার অন্যথা হয়নি।

একজনের কথা না বললে বরাহনগরের ভাড়া বাড়ির কথা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। উল্টো দিকে তার ডিসপেনসারি ছিল, পরবর্তীকালে ওয়ার্ড কমিশনারও হয়েছিলেন। পোশাকী নাম চিত্ত নিরঞ্জন সেন, সবাই ডাকতো ডাক্তার C N Sen বলে আর আমি অনেকদিন অব্দি জানতাম সেন সেন বলে। রেজাল্ট বেরোলে স্কুল থেকে ফেরার পথে তাঁকে দেখিয়ে তবে বাড়ি ঢুকতাম, চেম্বারে রোগী থাকলেও তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে দুবার ভাবতাম না। আমার জন্য বরাদ্দ থাকতো লজেন্স বা টফি। ডাক্তার কম, জেঠু ছিলেন বেশি; বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, খুব চাইতেন বাবা একটা জমি কিনে বাড়ি করুক। ডাকলেই বাড়িতে আসতেন, কমিশনার হওয়ার পরেও বলতেন এবার একটা জমি কিনুন চিত্র বাবু – আমি আছি, কিছু কমও করে দিতে পারবো। ওনার বাড়িতেও গেছি। আদ্যন্ত ভালো মানুষ, সবাই এক কথায় সেটা স্বীকার করেন। শেষের দিকে ডাক্তারির ধার কিছুটা কমে আসছিল, বিশু কাকুর বানানো কাঁচের শিশির মিক্সচার থেকে সরে লোকে তখন ডাইরেক্ট ওষুধ খাওয়া শুরু করছে। Dr. দীপক সেনগুপ্ত তো ছিলেনই (উনি আবার ঘটনাচক্রে আমার বন্ধুর বাবা), বসাক ডাক্তারও উঠে আসছেন। তাই ডাক্তারের থেকে অনেক বেশি উনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক। অনেক ডাক্তারবাবুই যখন আসতে চাইতেন না, ওই বাড়ির দোতলায় উনি সব সময়েই এসেছেন বিপদে পাশে দাঁড়াতে।

ভাড়া বাড়ির নিয়ম মেনে ফার্নিচারও খুব লিমিটেড ছিল, এর একটা কারণ যদি পরে বাড়ি করে নিয়ে যাওয়ার অসুবিধে হয় তাহলে আরো একটা বড় কারণ হল খুব সরু সিঁড়ি। ল্যান্ডিং এর জায়গাটা এতটাই কম ছিল যে একটা টেবিল ঘোরাতে কালঘাম ছুটে যেত। তাই একটা খাট, সোফা, আলনা আর একটা ছোটো ওয়ার্ডরোব – এই নিয়ে দোতলার ঘর। জানলা তে শিক আর কাঠের পাল্লা, একটা লম্বা জানলাকে আড়াআড়ি দুটো ভাগ করা। আমি বলতাম বড় আর ছোটো জানলা। ছোটবেলায় যখন ওপরের জানলায় হাত যেত না, তখন ওই ছোটো জানলায় বসে বাইরের রাস্তা দেখতাম। বাইরে বড় রাস্তা, বাস লরি সব যায় অনবরত; দেখতে দেখতেই সময় চলে যায়। শিলিগুড়ি থেকে বড়োদাদু এসে ছিলেন সাত দিন, খাটের পাশের ওই জানলার সামনে বসেই জপ করে কেটে যেতো অনেকটা সময়। আর বিকেলে রবীন্দ্রনাথ এর মত দাড়িওয়ালা দাদুকে হাত ধরে পাশের পুলিশ কোয়ার্টার এর ভেতরে হাঁটতে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। মা’র খুব প্রিয় ছিল এই জানলা, বারান্দার অভাব ভুলিয়ে দিয়েছিল। বিশেষত পুজোর সময় হাজার হাজার মানুষ দেখা ছিল এক বিরল অভিজ্ঞতা। আজও মা মিস করে ওই বাড়ি, ওই বাড়ির জানালায় দাঁড়িয়ে দূর্গা পুজোর ভিড়।

পুজোর কথা যখন উঠলো তাহলে বলি, এত কম জায়গায় এতগুলো পুজো আমি অন্তত কোনোদিন দেখিনি। বছরে দুবার পুজো হতো – সরস্বতী আর দুর্গা। তার মধ্যে সরস্বতী পুজো ছিল দেখার মতো, বড় রাস্তার ধারের প্রতিটা গলিতে হত। সামনে ফ্রেন্ডস ক্লাব, আসে পাশে তরুণ সঙ্ঘ, প্রান্তিক, আরো সব। খুব ছোটবেলায় নিয়ম করে বাবার হাত ধরে দিনের বেলায় সবগুলো ঠাকুর দেখতাম। একটা বাড়ির চারপাশে যদি পাঁচটা পুজো হয় তাহলে মাইকের অত্যাচারটা একবার ভেবে দেখার মতো। হেমন্ত, মান্না, কিশোর, লতা; বাংলা আর হিন্দি গানের এক অদ্ভুত মিশেল। ঘর থেকে যদি সতীনাথের গলা শোনা যায় তো বাথরুম থেকে মুকেশ আবার বারান্দা থেকে আশা। কার গান যে শুনব বোঝা দায়। তুলনায় দুর্গা পুজোর মাইকের তাণ্ডব ছিল অনেক কম। জানলার পাশেই পুলিশ কোয়ার্টারে ঢোকার চওড়া রাস্তা, আলো দিয়ে সাজানো থাকতো দু’পাশে আর সাথে বসত ঘুগনি, আলুকাবলি , আইসক্রিমের দোকান। কত সপ্তমী, অষ্টমী যে ওই জানলায় দাঁড়িয়ে কেটে গেছে তার শেষ নেই। বরাহনগরে অনেক দুর্গাপুজো হতো, প্রতি সন্ধেতে তিনজনের বেরোনো ছিল একদম মাস্ট। পাশে সোনাপিসীর কোয়ার্টারে অষ্টমীর পুজো দেওয়া আর বি আই কোম্পানি তে ধুনুচি খেলা সাথে ঢাকার বাজনা – এগুলো ছাড়া কোনো দুর্গা পুজোই পূর্ণ হতো না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.