দিনটা 15ই আগস্ট, 1989। স্কুল ছুটি, সারাদিন পড়া আর খেলার শেষে বছর বারো-তেরোর ছেলেটা দূরদর্শনের পর্দায় চোখ রেখেছে। একটা নতুন জিনিস হচ্ছে, গান, বাজনা আর নাচ। সবটাই পরপর, একসাথে। যেরকম ভাবে ছেলেটা শুধু গান শুনতে বা নাচ দেখতে অভ্যস্ত, সেইরকম না। গানবাজনার বাড়িতে জন্মাবার ফলে ততদিনে চেনা হয়ে গেছে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ভীমসেন জোশী, আল্লা রাখা, জাকির হুসেন, আমজাদ আলীদের। “বাজে সরগম হর তরফ সে”। সুর কানে লেগে গেলো, ছুটে গিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলো, কি রাগ এটা? মা বললো রাগ দেশ। বাবা যোগ করলো ভালো করে শুনে দেখ, শেষে বলা আছে দেশ রাগ। ভালো লেগে গেলো সুরটা। সেই শুরু দেশ রাগের ওপর ভালোবাসা। সাত-আট বছর ধরে গুরুজীর কাছে তবলা শেখার সুবাদে তখন তাল, মাত্রা সম্বন্ধে একটু একটু করে জানছি। এর সাথে ধেয়ে এলো রাগ।
আমার গানের জ্ঞানের হাতেখরি দাদুর হাত ধরে। মামাবাড়িতে গেলে দাদু একটা খাতা দেখাতো, সেখানে সবার ছবি কাগজ বা ম্যাগাজিন থেকে কেটে আটকানো। নিচে নাম লিখে রাখা। পাঁচ-ছয় বছর বয়সেই আমি জেনে গেছি নিসার হুসেন খাঁ, আহমেদজান থেরকুয়া, হাফিজ আলী খাঁ আর তাদের বংশলতিকা। দাদু খুব ভালো বেহালা বাজাতো, পোস্ট অফিসের চাকরি শেষ করে রোজ সন্ধেবেলা রেওয়াজে বসত। যদি কোনোদিন কোথাও বাজানো থাকতো, তাহলে আলাদা। আমি পাশে বসে শুনতাম। মাঝে মাঝে মামাও বাজাতে বসত। আর আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতাম, যে মা আমার গান সম্বন্ধীয় সব প্রশ্নের উত্তর জানে, সেও দাদুকে জিজ্ঞেস করছে। ততদিনে দাদুর বন্ধু আমার গুরুজীর কাছে তবলা শেখা শুরু করে দিয়েছিলাম, নাহলে হয়তো বেহালা বাজানোই শিখতাম। দাদুর কথা আর তবলা শেখার ইতিহাস আলাদা, অন্যত্র আলোচনা করা যাবে। যাই হোক, দাদুকে বলেছিলাম দেশ রাগের কথা। কিছু শিক্ষক এমন থাকেন যাদের শেখানোর ধরনের জন্যে গোবর মাথার ছাত্রও পাশ করে যায়। রাগের গভীরতার মধ্যে ওইটুকু ছোট ছেলেকে না নিয়ে গিয়ে বলে দিলো কিনা বন্দেমাতরম শোন। বলে গুণগুণ করে রাগের চলনটা বুঝিয়ে দিলো। সেই সময়ে ইচ্ছেমতোন কিছু শোনার পরিস্থিতি ছিল না, তাই আগে অনেকবার শোনা হলেও এর পর পুরো বন্দেমাতরম শুনতে অনেক মাস লেগে গেছিল। যেদিন শুনেছিলাম, গায়ে কাঁটা দিয়েছিলো। দেশ রাগের এত পরিষ্কার ব্যবহার দেখে। আরো ভালো লেগে গেলো এই রাগ। শুনে ফেললাম সেতার, সরোদে আর অসাধারণ কিছু কন্ঠে যতো দেশ রাগ পেলাম।
একটা সময় অবধি আমি বেশ জোর গলায় বলতাম, আমি দেশ রাগ চিনতে পারি। ছোটবেলার স্বভাব আর কি, অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী। আর কোনো রাগ না জানলে যা হয়, তাই। রাগ যে প্রহরের সাথে যুক্ত, প্রতি দু’ঘন্টায় একটা প্রহর হয়, বারোটা প্রহর নিয়ে একটা দিন, অষ্ট প্রহর কীর্তন – এসব জেনেছি অনেক পরে। জেনেছি, দেশ রাগ সন্ধ্যার পরে থেকে গভীর রাতের রাগ, তিলক কামোদ আর খাম্বাজের সাথে খুব মিল এই রাগের। সাধনার সেই পর্যায়ে উঠতে পারিনি বলে সময় অনুযায়ী রাগের মাহাত্ম বুঝতে পারিনি, তবে দরবারী কানারা মাঝরাতে বা ললিত ভোরবেলা শুনতে সত্যি ভালো লাগে। রাগমালার পরের লেখাতে নাহয় সেগুলো বলা যাবে। আজ নাহয় “বর্ষার রাগ, সৃষ্টির রাগ” দেশ বা দেশী রাগই থাক।
যারা গাইতে পারেন আমার মা’র মত, তারা জানেন দেশ রাগে কোমল নি আর শুদ্ধ নি’ র গুরুত্ব আরোহণ আর অবরোহনে। এর বেশি আমি জানি না, গাইতেও পারি না; শুধু প্রাণভরে শুনতে পারি। যেমন সারাদিন অজস্র রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে দেশ রাগের গান হলেই আলাদা করে বুঝে নিতে পারি। যদি কেউ আমার মত ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অমনোযোগী ছাত্র থাকেন, তাহলে দেশ রাগ শোনার একটা টোটকা বলে দি। বেশ কিছু রবীন্দ্রনাথের আর হিন্দি সিনেমার গান আছে। মূল চলন আর অন্তর্নিহিত সুর বুঝতে পারলে দেশ রাগ সম্বন্ধে একটা ধারণা হবে। আর পুরোটা জানতে গেলে প্রথাগত তালিম নিতে হবে।
রবীন্দ্রনাথের গানের জন্যে শরণাপন্ন হই বাবার কাছে – এর থেকে ভালো গীতবিতান আমার অন্তত জানা নেই। একে একে অনেক গান সামনে এলো যা আগে অনেকবার শুনেছি। কিন্তু ছোটোবেলায় দেশ রাগ শোনার পর সেই গানগুলো আবার নতুন করে শুনলাম, শুনে দেখতে পারেন আপনারাও।
- আমার যে সব দিতে হবে
- আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান
- এই লভিনু সঙ্গ তব
- এসো শ্যামল সুন্দর
- কাঁদালে তুমি মোরে
- ক্ষমিতে পারিলাম না যে
হিন্দি গানের কথা যখন উঠলো, তখন কিছু গান মনে পড়ছে যেগুলোর মধ্যে দেশ রাগের ছোঁয়া আছে। তিন-চারটে মনে পড়ছে আপাততঃ
- রবিশঙ্করের সুরে একটা গান – Sanware ke rang ranchi; এর বেশি মনে নেই
- লতা মঙ্গেসকরের গলায় Kesariya Balama
- রাহুল দেব বর্মনের শেষ কাজ 1942 A Love Story তে Pyaar hua chupke se
এইগুলো মনে পড়লো স্মৃতি থেকে, হয়তো আরো আছে; আমার বিদ্যে এইটুকু। দেশ রাগ আজ এই পর্যন্ত, পরে না হয় অন্য কোনো ভালোলাগা রাগের ওপর বলা যাবে।