“জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি” – না, কবির মতো এই কথা বলার সুযোগ পাইনি। বরং, জন্মের পর জ্ঞানের চোখ খুলে দেখেছি শুধু বই আর বই। বরানগরের বাড়িতে শোয়া বসার জায়গা ছিল কম, বেশিরভাগটাই দখল করে থাকতো ইতস্তত এদিকে ওদিকে ছড়ানো ছেটানো অসংখ্য বই। বেশীরভাগই বাংলা, বাকিটা ইংরেজি। বই নিয়ে বলতে গেলে দিন আর রাত পেরিয়ে যাবে, তাই সেটা কুলুঙ্গিতে তোলা থাক আপাততঃ।
গল্পের বইয়ের পরে গোটা ছোটবেলা জুড়ে যেটা ছিল সেটা হল গান। মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীত, এর সাথে যোগ হয় নজরুলগীতি, রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, আধুনিক গান আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। হিন্দি শুনেছি প্রথমে লুকিয়ে বিবিধ ভারতীতে, পরে একটু বড় হয়ে লাইসেন্স পাই। রবীন্দ্রনাথের গানে একটা আলাদা আকর্ষন অনুভব করতাম সেই ছোটো থেকেই। প্রথমে সুর টানতো, পরে বাবার উপদেশ মত কথার মানে বোঝার চেষ্টা করতে আরম্ভ করি। এক নতুন জগত খুলে গেলো সেদিন থেকে।
বাবা নিজের গান শোনার শখে আমার জন্মের প্রায় দশ-বারো বছর আগেই কিনে ফেলে একটা রেডিওগ্রাম। এখন যেরকম রেডিও দেখে আমরা অভ্যস্ত, সেইরকম নয়। HMV Safari Fiesta ছিল একটা সাদা রঙের বাক্স, যার বাইরে রেডিও আর ডালা খুললে রেকর্ড প্লেয়ার। MW আর SW ব্যান্ড ছিল তখন রেডিওতে, নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটা লাল কাঁটা কলকাতা ‘ক’, কলকাতা ‘খ’ আর বিবিধ ভারতীতে এনে শুনতে হতো। প্রায়শই টিউনিং ঠিক করতে হতো, নাহলে ঘরঘর একটা আওয়াজ আসতো। ইলেকট্রিক আর ব্যাটারি দুটোতেই চলতো এই রেডিওগ্রাম আর পরবর্তীতে একটা আউটপুট পয়েন্ট করা হয়েছিল একটা শুধু আলাদা স্পিকার বক্স বাজবে বলে। সময়টা ষাটের দশকের শেষ দিক, তখনই আজকের মত ব্যবস্থা ছিল, ভাবা যায়? রেডিওর সাথের অংশের আবেদনও কম না – একটা গোল চাকতি, পাশে রেগুলেটর এর মত অফ-অন সুইচ আর পরপর 33, 45, 78 এইসব লেখা। 33, 45 rpm এর রেকর্ডগুলো একটু ছোটো সাইজের হতো, আর 78 ছিল বেশ বড়। কুচ্কুচে কালো রেকর্ড, মাঝে লাল লেবেল, তার ওপর শিল্পীর নাম, গানের তালিকা সব থাকতো দুই পিঠে। সাথে ছিল সেই বিখ্যাত কুকুর (Nipper) আর তার মনিবের (Mark) গ্রামাফোন (His Master’s Voice)। রেকর্ড বসিয়ে rpm সেট করে পাশে স্ট্যান্ডে রাখা পিন একদম বাইরে প্রথম ট্রাকে হালকা করে ছুইঁয়ে দেওয়া ছিল এক শিল্প। এক অদ্ভুত প্রশান্তি আসতো গানটা শুরু হলে। ছোটবেলায় ওটা ছিল সবচেয়ে বড় অ্যাচিভমেন্ট। পিন এর মুখ ভেঙে গেলে বা বেঁকে গেলে রেকর্ড এ স্ক্রাচ পরে যেতো, পিন চেঞ্জ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকতো না। একটা কথা বলতেই হবে – রেকর্ডের গানের মিষ্টতা অতুলনীয়; ক্যাসেট বা সিডি এর ধারে কাছে আসতে পারে নি। কলের গান বা চোঙ্গাওয়ালা গ্রামাফোনের গান ছোটবেলায় শুনিনি, কিন্তু রেকর্ড প্লেয়ারের ওই গান আজও এতো বছর পর কানে বাজে। যশোর রোডের ওপর HMV এর অত বড় ষ্টুডিও আজ কতবছর কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এহেন বড় ভারী রেডিওগ্রামের হ্যান্ডেল ধরে বাবা প্রত্যেক গরমের আর পুজোর ছুটিতে সেটাকে নিয়ে যেতো হয় মির্জাপুর কিংবা কৃষ্ণনগর। আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি কিন্তু ভাবতে ভারী অবাক লাগে আজও। LP বা Long Playing রেকর্ড (আর ছিল EP রেকর্ড) বাড়িতে অনেক ছিলো, প্রথম পছন্দ ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এর রবীন্দ্রসঙ্গীত। আর ছিল নজরুলগীতি বা অতুলপ্রসাদ কিংবা রজনীকান্তের রেকর্ড, তুলনায় একটু ছোট সাইজের ছিল এই রেকর্ডগুলো। লেবেলে HMV কিংবা কলম্বিয়ার লোগো। রেকর্ডগুলো রাখা থাকতো পিচবোর্ডের কভারে, (অনেক পরে এই কভার তৈরির কারখানা আর লাগোয়া মিউজিয়াম গেছিলাম, লিখেওছি সেটা নিয়ে Bangalore Diary তে) সাথে শিল্পীর ছবি, সব বাদ্যযন্ত্রীদের নাম; গানের লিস্ট থাকতো পেছনে। পাশেই সোনাপিসীর বাড়িতে ছিল শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা, শাপমোচন, তাসের দেশ সহ সব গীতিনাট্য আর নৃত্যনাট্যের রেকর্ড; নিয়ে এসে শুনতাম এক এক করে। ওখান থেকেই প্রথম নিয়ে এসে শুনি সাগর সেন আর ডি ভি পালুস্করের ভজন (আগে লিখেছি)। মোম থেকে ভিনাইল – নানান রেকর্ডে দিকপাল শিল্পীদের কন্ঠ ধরা আছে, বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে, কিছু আর্কাইভ এ আছে। এখনও চোখে ভাসে বাড়িতে থাকা রেকর্ডের সেই কালেকশন – হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নিশীথ সাধু, নীলা মজুমদার, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, চিত্রলেখা চৌধুরী, ধনঞ্জয়/পান্নালাল ভট্টাচার্য, সতিনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন প্রমুখ।
রেকর্ডের কথা বললেই ক্যাসেট সাথে সাথে চলে আসে। ভেবেছিলাম ক্যাসেটকে এর মধ্যে আনবো না, কিন্তু রেকর্ডের মৃত্যুঘন্টা যে বাজালো তাকে অস্বীকার করি কি করে? প্রথম ক্যাসেট প্লেয়ার উপহার পাই মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করার পর। Videocon এর দুটো স্পিকারওয়ালা সিস্টেম সাথে একদম নতুন আসা FM ব্যান্ড। আজও চলছে সেটা সগৌরবে অনেক রজনী অতিক্রম করে। দোকানদার ভালোবেসে যেকোনো দুটো ক্যাসেট পছন্দ করে নিতে বলেছিলো, আমি নিয়েছিলাম অজয় চক্রবর্তীর “রাগের বাহারে” আর ফিরোজা বেগমের নজরুলগীতির সংকলন। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর পরে আজও মনে পরে সবকটা রাগপ্রধান গান – ‘ডাগর নয়নে’ দিয়ে শুরু, একে একে ‘কারে বা জানাই’, ‘কাছে এসে ভালোবেসে’, ‘পাখি কেন গাহে না’, ‘নিশি না ফুরালে’ আর সবশেষে ‘পিয়া ভোলো অভিমান’। সেই শুরু, তার পর থেকে কত রকমের ক্যাসেট কিনেছি তার হিসেব নেই, সব যোগ করলে সংখ্যা প্রায় হাজারের ওপর। বাংলা আর হিন্দি গায়কদের এতো লম্বা লিস্ট লেখা সম্ভব নয়, রবীন্দ্রসংগীত থেকে রাগপ্রধান, নজরুলগীতি থেকে শাস্ত্রীয় সংগীত, কিশোর কুমার থেকে কুমার শানু, অনেক চার-ছয়-আট ক্যাসেটের অ্যালবাম, জীবনমুখী থেকে ব্ল্যান্ক ক্যাসেট রেকর্ডিং – কি ছিল না স্টকে। বেশিরভাগ কিনতাম শিয়ালদহ স্টেশনের উল্টোদিকে ফ্লাইওভার এর নিচে শিশির মার্কেটের বিল্লার দোকান থেকে, কলেজ স্টুডেন্ট বলে প্রায় 40% ডিসকাউন্ট দিতো। সুমনের ‘তোমাকে চাই’ খুঁজতে খুঁজতে ধর্মতলার Symphony তে পৌঁছে গেছিলাম আর নচিকেতার প্রথম ক্যাসেট ‘এই বেশ ভালো আছি’ নিয়েছিলাম নচিদারই হাত থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু গুল্লুস এর সৌজন্যে। কালের নিয়মে ক্যাসেট রাস্তা করে দিলো সিডি, ডিভিডি, mp3 কে। History repeates, সবারই একটা শেষ আছে।
আজও কিন্তু রেকর্ডের ওই মিষ্টি গলাটা মিস করি। যে রেকর্ড শুনে আমার কান তৈরি হয়েছে (গলাটা বেসুরোই থেকে গেছে), কি ভালো হতো যদি আবার সেটা ফিরে আসতো। স্বামীজী বলেছিলেন, পিছন ফিরে তাকাতে নেই; তবুও মন চায় বারবার অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে। ভালো হতো না কি যদি cloud থেকে গান না শুনে আসল দুধটাই খেতে পারতাম! বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না।