স্কুল ছুটি চারটে দশ। ঠিক চারটে পঁচিশে তার রিকশা যায় বড় রাস্তা দিয়ে। কুড়ি মিনিটের রাস্তা দৌড়ে আসতাম পনেরো মিনিটে। অনেক দিন হয়েছে দেখতে পাইনি, হয়তো একটু আগেই পেরিয়ে গেছে অথবা আজ সে স্কুলেই যায়নি। যেদিন দেখা হতো, কোনোদিন সে একটু হাসত আবার কোনোদিন দেখেও দেখত না। সুন্দরী ছিল বলে চাপা একটা অহংবোধ ছিল। প্রথম ভালোলাগা তাকেই, স্কুলের গণ্ডী না পেরোনো অবস্থায়। পড়তে গিয়ে যখন দেখা হতো, তখন সে বেছে নিত আমার পাশের চেয়ারটাই, যা কিছু না বুঝতে পারা আগে আমাকেই, তারপর স্যারকে; অথচ রাস্তায় না চেনার ভান করতো। অনেক পরে জেনেছিলাম, রিকশাওয়ালা ওর মাকে নিয়েও অফিস যেত – যদি কিছু বলে দেয়; তাই জানতে দেয়নি কিছু।
আমাকে ভালোলাগা – এটা অবশ্য আরও আগে। মর্নিং এর ফার্স্ট গার্ল বোর্ডে লিখে রেখেছিল, হতাম যদি তোতা পাখী / তোমায় গান শোনাতাম / হতাম যদি বন ময়ূরী / তোমায় নাচ দেখাতাম। সেটাও জেনেছি অনেক পরে, তার নিজের মুখ থেকেই। যদিও আমার ভালোলাগার রাডারে সে ছিল না।
আমার থেকে একটু বড়, আলাপ পড়তে গিয়ে। সে প্রতি শনিবার ফেরার সময় আমার হাত ধরে ফিরত বড় রাস্তা দিয়ে। যেখানে আমার জন্ম, যেখানে আমার বড় হওয়া সেখানে আমারও কোনোদিন মনে হয়নি যে হাত ছেড়ে হাটতে হবে। সেই বোধটাই তৈরি হয়নি, পরে শুনেছি তার ভালো লাগত আমায় কিন্তু বয়সে ছোট বলে কোনোদিন সে কিছু বলেনি।
সরস্বতী পুজোতে এদের সবার সাথে দেখা হয়েছে কোন না কোন ভাবে। ঘুরেছি একসাথে, পরের দিন বাড়ি গিয়ে গোটাসেদ্ধও খেয়েছি। ভালোলাগা আর ভালোবাসার তফাত জানা ছিল না তখন।
মনে পড়ে, কিভাবে সরস্বতী পুজোর নেমন্তন্ন করার দলে ঢুকে পরতাম শুধু মেয়েদের স্কুলে ঢোকার অধিকার পাবো বলে। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে কলেজ জীবনেও। শাড়ি পরা মেয়েরা একদিনের জন্য ভিন গ্রহের প্রাণী, সেই না চেনাকেই চেনার জন্য এত আয়োজন।
ভ্যালেন্টাইন ডে তখনও থাবা বসায় নি বেডরুমে। গ্রিটিংস কার্ড সবে এসেছে বাজারে। কার্ড পেলে ব্যাগে বা বইয়ের পেছনে লুকিয়ে রাখাই দস্তুর। আজকের মত উদার মানসিকতা তখন এত ছিল না – যদিও আমার সব বন্ধুরাই আমার বাড়িতে আসত, সারা দিন থাকতো। কোনদিন কাউকে সন্দেহ করতে দেখিনি, অবশ্য প্রেমের ব্যাপারে আমি বরাবরই আনাড়ি। তাই হয়তো অনেকেই শেষমেশ রাগ করে আর হাল ছেড়ে চলে গেছে – সংখ্যাটা নেহাত কম না সেটা স্বীকার করি। আজ অনেকেই ভেসে ওঠে, মাঝে মাঝে কল্পনায় ভাবি সত্যি যদি তাদের কোন একজনের সাথে কাটিয়ে দিতে হতো সারাটা জীবন – তবে কে হত সে আর কেমন হতো জীবন। প্রশ্নগুলো সোজা তবে উত্তর অজানা।
তাই বলে আমারও কি ভালো লাগেনি কাউকে? নাম না জানা সেই মেয়েটি যাকে প্রতি সোমবার দেখতাম দূরপাল্লার বাসে তিন ঘণ্টা, টানা এক বছর অথচ কোনোদিন কথা বলিনি কিংবা কলেজ জীবনে সেই বান্ধবী যে নিজের প্র্যাক্টিকাল শেষে দাড়িয়ে থাকতো বাস স্ট্যান্ডে আমার সাথে ফিরবে বলে – যার সাথে টানা দু’বছর থেকেও বলতে পারিনি কিছু। ধূমকেতুর মত অনেকে এসে হটাত ছিটকে বেড়িয়ে গেছে; হয়তো বা আমারই দোষে। ভালোলাগাকে ভালবাসতে পারিনি যে।
কর্মজীবনের ভ্যালেন্টাইনদের কথা নাহয় অন্য একদিন হবে।
সব চরিত্র ………