আমার জন্ম ভাড়া বাড়িতে। না, তাই বলে বাড়িতে ধাই মা’র হাতে জন্মাই নি। জন্মেছিলাম মাতৃসদনে, ডাক্তার আর নার্স পরিবেষ্টিত হয়ে। পূর্ণিমাটা একটুর জন্য মিস হয়ে গেছিল, তাই আমিও অন্যদের মত বিখ্যাত হতে পারলাম না!
বরাহনগরের ওই বাড়ি আমার সাবালক হওয়ার সাক্ষী। অনেক স্মৃতি, আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট জড়িয়ে আছে ওই বাড়ির দোতলা আর তিনতলা ঘিরে। পুরোদস্তুর শহর বলতে যা বোঝায়, বরাহনগর সেটাই; আর আমরা থাকতাম তার প্রাণকেন্দ্রে। আমার জন্মের প্রায় চৌদ্দ-পনেরো বছর আগে বাবা আসেন এখানে। স্কুলের চাকরিই প্রধান কারণ। বিরাটি থেকে গঙ্গার ধারের স্কুল অনেক দূর হয়ে যাচ্ছিল, তাই এক সহকর্মীর বদান্যতায় এই বাড়ি পাওয়া। দোতলায় একটা ঘর, ঢাকা বারান্দা, বাথরুম আর তিন তলায় ছাদ লাগোয়া একটা ঘর, খোলা বারান্দা আর রান্নাঘর। একতলায় তিনটে দোকান, দু’ঘর ভাড়া। দোতলায় সামনে দুটো ঘর নিয়ে বাড়িওয়ালার নিকট আত্মীয় থাকে, ছাদে একটা ঠাকুর ঘরও তাদের। যার বাড়ি তিনি ভাড়া দেওয়ার সময়ে বলেছিলেন, এখানে যতো ভাড়াটে থাকেন সবার নিজের বাড়ি হয়ে যায় একদিন। একটা পরিবার বাদে সবার ক্ষেত্রে আশ্চর্য জনক ভাবে মিলে গেছিল সেই কথা।
মধ্য তিরিশের সুপুরুষ শিক্ষিত এক যুবক ষাটের দশকে যখন এই অঞ্চলে আসেন, বেশি সময় লাগেনি সবার প্রিয়পাত্র হতে। শিক্ষকদের সম্মান তখন আরো অনেক বেশি ছিল আর সেটা হতো নিজ গুণেই। বেশিরভাগ ডাকতো মাস্টারমশাই বলে আর কেউ কেউ ‘সাহেব’ বলে তার সৌন্দর্যের জন্য । কেউ নামের সাথে দাদা যোগ করে ডাকতে পারেনি তার ব্যক্তিত্বের জন্য, এ নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন গর্বও ছিল তাঁর। ঠিক যেমন তারই এলাকার বিধায়ক জ্যোতি বসুকে কেউ জ্যোতিদা বলে ডাকতে শোনেনি। এহেন মানুষের ছেলে আমি, তাই সবার ভালোবাসা প্রথম দিন থেকেই পেয়েছি।
একেবারে বড় রাস্তার ওপর বাড়ি, দু’পাশে লাগোয়া আরো সব বাড়ি আর নিচে দোকান। কি ছিল না ওই জায়গাতে! আর সবই ছিল দুটো বা তিনটে করে। মুদির দোকান, ওষুধের দোকান, এখন হারিয়ে যাওয়া অ্যালোপ্যাথি আর হোমিওপ্যাথি ডাক্তারদের ডিসপেনসারি, ইলেকট্রিকের দোকান, আর অসংখ্য পান-বিড়ি-সিগারেট এর দোকান। যখন যা চাই সব হাতের কাছে, কোনোদিন কোনো কিছুর অভাব অনুভূত হয় নি। আমার ব্যক্তিগত ভাবে সবচেয়ে ভালো লাগতো একটা জিনিস। আমরা সেই বিরল প্রজাতির লোকেদের মধ্যে পড়তাম যারা বাস স্ট্যান্ডে বাস এসেছে দেখে দরজায় তালা দিয়ে নেমে বাড়ির সামনে থেকে বাস ধরতাম। জানিনা আর কারুর এমন অভিজ্ঞতা আছে কিনা। ডানলপ থেকে ছেড়ে আসা 34B বা বনহুগলী থেকে আসা 43 বাসে তখনকার দিনে আমাদের নিয়োগীপাড়ার স্টপেজ থেকে উঠেই সীট পাওয়া যেত। বিরল সেই অনুভূতি।
বড় রাস্তা বলে রকের আড্ডা তেমন ছিল না, তবে কিছু বাড়ি পরপরই একটা করে কানা গলি ছিল, সেই গলির মুখে ছেলে-ছোকরারা আড্ডা মারতো সকাল-সন্ধ্যা। কোনোদিন তাদের মুখে মেয়েদের প্রতি টোন টিটকিরি মারতে শুনিনি, অথচ সবাই যে ভালো ছেলে ছিল তাও নয়। আমি বড় হওয়ার পর অনেকেই দুঃখ করেছে যে বাবার জন্য তাদের সিগারেট খাওয়া প্রায়শই মাটি হয়ে যেতো। কিন্তু সেই নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিলো না কারুর, এরাই আবার পুজোর সময়ে আসতো চাঁদা নিতে। বাবা যেটা দিত কোনো কথা না বলে নিয়ে যেত। অথচ, একদম শুরুর দিকে এদের সাথেই নাকি বাবার একবার খুব ঝামেলা হয়েছিল। বাবার মুখেই শোনা, একদিন স্কুল থেকে এসে দেখে সরস্বতী পুজোর জন্য তিন তলার ঘরের বাইরে যে সুইচ বোর্ড আছে সেখান থেকে লাইন নিয়ে লাইটিং করা হয়েছে। লাইন দিতে আপত্তি নেই, আপত্তি না বলে নেওয়ার জন্যে। লাইন খুলে দিয়েছিল বাবা, আশে পাশের কিছু মাস্তান গোছের দাদা এসে বলেছিল, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে ব্যাঁকা আঙুলে তুলতে আমরা জানি। নতুন জায়গায় মাস খানেক আগে আসা বাবার উত্তর ছিল, ব্যাঁকা আঙুলকে আবার সোজা করতে আমিও জানি। অদ্ভুত ভাবে, এরাই অসম্ভব সম্মান করেছে বাবা আর মাকে পরবর্তী কালে – যে কোনোদিন কোনো অসুবিধা হলে এরাই ছুটে আসতো সবার আগে। অনেকেরই নাম আর মুখ মনে পড়ছে, থাক সে কথা।