সবে তখন বাড়ি করে বেলঘড়িয়াতে এসেছি। হঠাৎ একদিন সকালে উঠে দেখা গেলো বাড়ির পেছনে কুয়োর পাশে রাখা লোহার বালতিটা নেই। খোঁজ খোঁজ – পাওয়া গেলো না আর। নতুন আর একটা কেনা হল। কিছুদিন পর শুনলাম পাশের পাড়ায় একটা সাইকেল চুরি হয়েছে। আগে যেখানে থাকতাম সেই বরাহনগরে চুরি কাকে বলে জানতাম না। সবসময়ই যে দোতলার দরজায় তালা দিয়ে নিচে দোকানে বা সামনে বাজারে যাওয়া হত, সেটা নয়। কিন্তু কোনোদিন কিছু চুরি হয় নি। যাই হোক, কিছু মাস পর বাড়ির পেছনে টমেটো, উচ্ছে ফলানোর কাজে লাগা লোহার একটা খুরপিও হাপিস হয়ে গেলো। বাবা তখনও আশাবাদী যে চোর নাকি আবার এগুলো ফেরত দিয়ে যাবে, ঠিক যেমন তার সাথে হয়েছিলো বিরাটির বাড়িতে। বরাবরের আপনভোলা বাবা তালা না দিয়ে বিরাটি থেকে বরাহনগরে স্কুলে এসেছিল রোজকার মত। বাড়ি ফিরে দেখে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কেউ একটা ফাইল নিয়ে হাওয়া – তার মধ্যে টাকা থেকে রেশন কার্ড, সার্টিফিকেট থেকে চাকরির কাগজ সবই নাকি ছিল। শিক্ষিত চোর দু’দিন পরে টাকা ছাড়া সবকিছু আবার জানালায় রেখে গেছিল।
এখানে সেইরকম কিছু হয়নি, চোরও কিছু ফেরৎ দিয়ে যায় নি। কিন্তু যেটা হয়েছিলো সেটা চোরের জিনিস ফেরৎ দেওয়ার মতোই টানটান উত্তেজনার। তখন আজকের বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেসওয়ে হয়নি, চলতি কথায় আমরা তখন সেটাকে দিল্লী রোড বলে ডাকি। মাস্টার্স করে সবে চাকরিতে ঢুকেছি, তা প্রায় আজ থেকে বছর কুড়ি আগে। একবেলা চাকরি করি, আর একবেলা পড়াশোনা করি আরও একটু বড় হওয়ার জন্যে। সেই সুবাদে বেশ রাতে বাড়ি ফিরি, নির্জন দিল্লী রোড ধরে আপন মনে। এদিক ওদিক কিছু লোক আড্ডা মারে, কিছু উঠতি ছেলে লুকিয়ে চুড়িয়ে নেশাভাঙ করে। এমনি এক রাতে ফিরছি একা, ভাবছি সারাদিন কি করলাম আর কাল কি করব – হঠাৎ পাশে একজন উদয় হলো। Social Distancing এর কোনো concept তখন ছিল না, তবুও লোকদের মধ্যে বেশ দূরত্ব থাকতো ওই অন্ধকার রাস্তায়। অন্ধকারে ঠিক ঠাহর করতে না পারলেও বুঝতে পারলাম মুখটা চেনা। সে নিজেই বললো, মাঠের পাশে থাকে, আমায় চেনে নতুন এসেছি বলে। এ কথা সে কথা হতে হতে একদিন দেখি আমরা প্রায়ই একই সময়ে ওই রাস্তা ধরে গল্প করতে করতে বাড়ি ফিরি, ফ্যাক্টরি শেষে এটাই ওর টাইম। গল্পের বিষয় রাজনীতি থেকে খেলাধুলা – ততদিনে ভালো করে দেখে নিয়েছি তাঁকে। একটু কালো রঙ, মাঝারি হাইট, কথাও বলে খুব আস্তে। তবে আমায় আকর্ষণ করেছিলো তার এক জোড়া চোখ, কথা বলছে মনে হয়; খুব কাছের মিল পেয়েছিলাম ক্রিকেটের Muralidharan এর সাথে।
বোমাটা সে নিজেই ফাটালো একদিন, তাও আলাপ হওয়ার প্রায় এক বছরের মাথায়। হয়তো বিশ্বাস এসে গেছিল আমার সাথে মিশে, তাই নিশ্চিন্তে বলতে পেরেছিলো যে, সে আদতে একজন চোর। হজম করতে একটু টাইম লেগেছিল আমার, কিন্তু যখন একে একে সব চুরির কথাগুলো মনে পড়িয়ে দিলো তখন আর সন্দেহের অবকাশ থাকলো না। হ্যাঁ, আমাদের বালতি, খুরপিও রাতের অন্ধকারে ওই চুরি করে বিক্রি করে দিয়েছিলো। আমায় বলেছিলো, চুরির আদর্শ সময় রাত আড়াইতে থেকে চারটের মধ্যে – এই সময়ে মানুষের ঘুম সবচেয়ে গভীর হয়। ক্লাস এইট অব্দি পড়া মানুষটা সেটা জানে ভেবেই চমকে উঠেছিলাম। তার আগে শুধু জানতাম, চোরেরা গায়ে তেল মেখে বেরোতো; সেটাও যারা সিঁধেল চোর তারাই। আরো ছ’মাস শুনেছিলাম আসেপাশের পাড়ার কোন বাড়িতে কোন রাতে কি ভাবে কি কি চুরি করেছে, চোরাই জিনিস কোথায় বিক্রি করে আর সেই পয়সায় কি করে সে। পুরোটা নাহয় নাই বা বললাম, কিছুটা আমার ভেতরেই থাক। এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা, হয়তো মানুষটিকে তার সম্মান দেওয়া হয়েছিল বলেই সে এত কিছু বলেছে আমায় বিশ্বাস করে। আমার বাড়ি ফেরার সময় পাল্টে যাওয়ায় তারপর আগের মত দেখা হতো না, কিন্তু মাঝে মাঝেই দেখা হতো রবিবারের দুপুরে।
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, তারপর থেকে বিগত কুড়ি বছরে আমাদের বাড়িতে আর কিচ্ছুটি চুরি হয়নি।
সত্যি????
হ্যাঁ, সত্যি