রবীন্দ্রনাথের বাড়ি – কোনার্ক

প্রথমে এই বাড়ির নাম রাখা হয় উত্তরায়ণ। পরে যখন গুরুদেব মনস্থ করলেন যে শান্তিনিকেতনে ‘উত্তরায়ণ’ কোনো একটা বাড়ি হবে না, অনেকগুলো বাড়ি নিয়ে হবে তখন এই বাড়ির নাম রাখা হলো কোনার্ক। শান্তিনিকেতনের বাকি বাড়িগুলোর থেকে কোনার্ক সবদিক থেকেই আলাদা, প্রায় সারাবছর রবীন্দ্রনাথের পরশ লেগে থাকতো এই বাড়ির উঠোনে।

আসুন, আজ পঁচিশে বৈশাখে সেইসব বাড়িগুলোর একবার ঘুরে দেখি যাদের পরতে পরতে লেগে আছে রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া আর গন্ধ। উত্তরায়ণের পাঁচটা বাড়ি স্ব স্ব মহিমায় পরিচিত – উদয়ন, শ্যামলী, উদীচী, পুনশ্চ আর কোনার্ক। বাকি বাড়িগুলোর সম্পর্কে একে একে বলবো, আজ শুধুই কোনার্ক।

রবীন্দ্রনাথের অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল একটা খোলা বারান্দা যেখানে তিনি তার কবিতা আর নাটক পাঠ করতে পারবেন, তার নৃত্যনাট্যগুলো মঞ্চস্থ হবে একদম প্রকৃতির মাঝে। সেই পরিকল্পনার ফসল এই কোনার্ক ভবন। সূর্যোদয়ের আগেই ভোররাতে রবীন্দ্রনাথ এসে বসতেন এই বাড়ির বিশাল বারান্দায়। ১৯১৯ সালে শুরু হয়ে ১৯২২ সালে শেষ হওয়া তিনদিক খোলা পুবের লাল বারান্দা ছিল কোনার্ক মাটির বাড়ির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। যদিও প্রথমে মাটি, কাঁকর আর পাথর পিটিয়ে মেঝে করা ছিল আর মাথার ওপরে ছিল খড়ের চাল।

কোনার্ক বাড়ির বিশেষ আকর্ষণ ছিল বেশ নিচু ছাদ আর সমতলের থেকে কিছুটা উঁচুতে থাকা বসবার ঘর। আটটা ঘর নিয়ে তৈরী এই বাড়ির ছাদ ছিল বাকি সব বাড়ির থেকে অনেকটাই নিচু। সবদিক থেকে কোনার্কের গঠনশৈলী চোখে পড়বার মতোই। ঘর আর মেঝের উচ্চতার তারতম্য ইচ্ছে করেই করা হয়েছিল যাতে এই বাড়ির এক বিশেষত্ব তৈরি হয়। পরবর্তীতে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ নিজের হাতে উদয়ন বানাবার সময়ে যেমন ভেবেছিলেন, কোনার্ক অনেকটাই সেইরকম ছিল।

ব্যতিক্রমী রবীন্দ্রনাথ খোলা জানলা চেয়েছিলেন এই বাড়িতে, তাই কোনো গরাদ ছিল না এখানে। ঠিক তেমনি, কোনার্কের ঘরে কংক্রিটের আসবাবপত্র তৈরী করা হয়েছিল, যদিও পরে সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়। শান্তিনিকেতনে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্ভবত করা হয়েছে এই বাড়ির ওপরেই। কখনো বাড়ির উঁচু বারান্দাটা কাঁচ দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হলো চারপাশের সবকিছু ভালোভাবে দেখার জন্যে আবার কখনো ঘরের সব আসবাব পাল্টে গেলো কিছুদিনের মধ্যেই।

রবীন্দ্রনাথ থাকতেন উঁচু বসবার বারান্দার বাঁদিকে একটা সরু মতন ঘরে আর বারান্দায় ইজিচেয়ারে অথবা সিঁড়ির ধাপে বসে পড়ে শোনাতেন মিল্টন, বায়রন এর মতো কবিদের কবিতা। মন ও স্বাস্থ্য ভালো থাকলে আশ্রমিকরা শুনতে পেতেন জাপানি বা জার্মানি কবিতার বাংলা অনুবাদ। নটীর পূজা এখানেই প্রথম উপস্থাপিত হয়। এই বাড়িতেই থেকে গেছেন জহরলাল নেহেরু, কমলা নেহেরু, উইলিয়াম পিয়ারসন, চার্লস এন্ড্রুজ এর মতো দিক্পালরা।

কোনার্ক বাড়ির সামনে রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে একটা শিমুল গাছ পুঁতেছিলেন, নিজের হাতে পরিচর্যাও করতেন প্রতিনিয়ত। সাথে যোগ হলো একটা মাধবীলতা। আজও দুটো গাছ হাত ধরাধরি করে উঠে চলেছে ওপরের দিকে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তার পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী এই বাড়িতে দীর্ঘদিন বসবাস করে গেছেন।

একে একে আসবে উদয়ন, পুনশ্চর মতো বাড়িগুলোর কিছু অজানা কথা। আজ তবে এইটুকু থাক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.