2000 সালের জানুয়ারী মাস, দুপুর 1.10, শ্যামবাজারের Manidra Chandra কলেজ বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়ি ফিরব 3 No বাসে করে। ফাঁকা বাসের শেষ পাদানিতে পা দিতেই প্যান্টের পকেটে কেউ হাত দিলো, চকিতে ঘুরতেই বাস থেকে নেমে গেলো সে। শ্যামবাজার অব্দি বাস আস্তেই যায়, তাই নামতে কোনো অসুবিধা হয়নি তার। লম্বা কানঢাকা চুল, মাঝখানে সিঁথি, মাঝারি উচ্চতা। সেই প্রথম আমার পকেটমার দর্শন। মানিব্যাগ তখনও নেওয়া শুরু করিনি, বুক পকেটে একটা পেন, বাঁ পকেটে রুমাল আর ডান পকেটে সামান্য কিছু টাকা। ঘটনাচক্রে সেদিনই কিছু প্রাপ্তিযোগ হয়েছিলো – জীবনের প্রথম উপার্জন। সেটাও চলে যাচ্ছিলো পকেটমারের কাছে। আজও বুঝিনি কি জাদুবলে সে বুঝেছিল যে আমার পকেট এ টাকা আছে!
এর পরে অনেক চোর, পকেটমার দেখেছি (এক লোকাল চোরের গল্প পরে বলবো), অনেকের সাথে আলাপ হয়েছে, জেনেছি অনেক নতুন তথ্য। মেট্রো র সেই পকেটমারকে তো আজও মনে আছে, মাঝবয়সী টাকওয়ালা একজন। দমদম থেকে ওঠেন, অফিসে চাকরি করতেন কিন্তু স্বভাব ছিল খারাপ। উনি দাঁড়াতেন ঠিক 2nd line এ। ট্রেন আসতেই ব্যস্ততা ছিল চোখে পড়ার মত। কিছুটা পিছনে থাকার সুবাদে একদিন দেখতে পাই একজনের মানিব্যাগ তুলে নেওয়া। ট্রেনে উঠে উনি কিন্তু সিটে বসতেন না, vestibule এ দাঁড়াতেন। অনুসন্ধিৎসার টানে আমিও গিয়ে দাড়াই vestibule এ, আস্তে আস্তে ভাব জমে ওঠে। 9.05 এর মেট্রো না ধরতে পারলে খুব কষ্ট হত, ওনার জন্যেই আমার vestibule এ দাঁড়ানোর habit যা আজও আছে। বেশ মনে আছে প্রথম দিকে একদিন বলে ফেলেছিলাম কেনো করেন এই কাজ? সেদিন কোনো উত্তর দেননি, পরে আলাপ গভীর হলে স্বীকার করেছিলেন, এটা ওনার স্বভাব। হাত নিশপিশ করে, হ্যাঁ, এই শব্দটাই বলেছিলেন। Dalhousie তে চাকরি করতেন, Mangoe লেন এ, সেন্ট্রাল এ নেমে হেঁটে যেতেন। আমিও গেছি ওনার অফিসে, দেখেছি ধর্মতলার ফুটপাথে শুয়ে থাকা অনেক ছেলের মুখের ভাত যোগাতেন তিনি ওই মানিব্যাগ থেকে পাওয়া টাকা পয়সা দিয়ে। কিছু বলতে পারিনি সেদিন, ঠিক যেমন সব জেনেও যার পকেট কাটলো তাকে বা পুলিশকে বলতে পারিনি ওঁর কথা। তখন মোবাইল এর এত রমরমা ছিল না, তাই ফোন নম্বরও রাখা হয়নি। খুব জানতে ইচ্ছে করে আজ উনি কেমন আছেন, কোথায় আছেন।
ঠিক যেমন জানতে ইচ্ছে করে মকবুল কেমন আছে – আমার পকেট মেরে আবার আমাকেই সাথে সাথে ফেরত দিয়ে বলেছিলো ভুল হতে গেছে ভাই, অন্য কাউকে খুঁজছিলাম। 9A বাস থেকে নেমে একসাথে Theatre Road এ Grilled Sandwich ও খেয়েছিলাম দুজনে, আমায় টাকা দিতে দেয়নি ওই ” পকেটমার ” – কারণ ও আমায় চিনে ফেলেছিল। ওর ভাই আমার সাথে স্কুলে পড়তো, আমায় দেখেছিল School Function এ একের পর এক প্রাইজ নিতে, সেই থেকে চেনা।
আমি চিনতাম একজনকে যাকে পকেটমাররা “ডাঁশা” বলত। এক বন্ধুর সাইকেল চুরি গেলো স্টেশন থেকে, আড্ডা মারছিলাম আমরা চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে, রোজকার মত। তার মধ্যেই এই অঘটন। চায়ের দোকানদার সাহায্য করলো, বলে দিলো কোথায় যেতে হবে। রাত্রে সেখানে পৌঁছাতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছিলো, দুই বন্ধু গেছিলাম বাড়িতে না জানিয়ে। অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছিলাম সাইকেল নিয়ে, শুধু আমার বন্ধুর 100 টাকা খরচ হয়েছিল। যে ফিরিয়ে দিয়েছিলো সেই কামারহাটির মুর্শেদ আর কোনোদিন আমাদের আড্ডা ঠেক থেকে সাইকেল তোলেনি; ভুল করে আমার সাইকেল সারা রাত বন্ধ চায়ের দোকানে চাবি ছাড়া হেলান দিয়ে রাখা সত্ত্বেও।
শেষ করব হাতকাটা খগেনের এর কথা বলে। বরানগর বাজারে বুক পকেট থেকে কেউ তুলে নেয় সব মিলিয়ে 2000 টাকা। তখন 100 টাকার নোট বেশি চলত, তাই বোঝাও যেতো যে পকেটে টাকা আছে। কিছু হারিয়ে বিলাপ করার ছেলে আমি কোনোদিনই না, যে গেছে তাকে ফেরাতে পারব না জানি। তবু কেন যেনো ইচ্ছে হল জানতে। পকেটমারদের এলাকা ভাগ করা থাকে জানি, তাই শেষবারের মত শরণাপন্ন হয়েছিলাম মুর্শেদ এর। বুঝিয়েছিলাম যে টাকাটা আমার না, অন্য একজনের, আমি শুধু দিতে যাচ্ছিলাম যার প্রাপ্য তাকে। মাঝে এই অনর্থ। মুর্শেদ লোক সাথে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল খগেনের এর কাছে, বরানগরের এর মাথা। নকশাল আন্দোলনে বোমা বাঁধতে গিয়ে বাঁ হাতটা উড়ে গেছে, ডান হাত দিয়ে দেখিয়েছিল কি অবলীলায় একটা ব্লেডকে চার টুকরো করে সেটা দিয়ে কচি লাউ এর ওপরের খোসা কাটা যায়, ভয় ভয়ে শিখেছিলাম কি করে জিভের তলায় ব্লেড রাখতে হয়, শুনেছিলাম কি করে শিকার চিনে তাকে ফলো করে সঠিক সময়ে হাতসাফাই করে ভিড় এর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। (শিকার চেনে রেলের টিকিট চেকাররাও, সে অন্য এক গল্প)। হাতকাটা খগেন পকেটমারি শেখাত, তাই সে ছিল ওস্তাদ। তার অনেক চেলা এখন স্বক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত।
।। সত্য ঘটনা অবলম্বনে, কোনো চরিত্র কাল্পনিক নয়, নাম অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে ।।