নতুন দক্ষিণেশ্বরে কিছুক্ষণ

আমার বাড়ি থেকে দক্ষিণেশ্বর মন্দির মেরেকেটে দু’কিলোমিটার। সেটুকু যেতেই এবার সাত-আট বছর লেগে গেলো!

গিয়ে দেখি সবই নতুন। আগের বার ডালা আর্কেড দেখে এসেছিলাম আর দোকানগুলো একটা জায়গায় একসাথে বসার চেষ্টা করছিল। এবার সব দোকান এক ছাদের তলায়।

একটা ফুড প্লাজা হয়েছে, তিন থেকে চারটে দোকান আছে। মোবাইল আর ব্যাগ রাখার জায়গা আগেই হয়ে গিয়েছিল, পার্কিং ব্যবস্থাও খুব ভালো।

নারী পুরুষ সুশৃঙ্খলভাবে লাইন দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে, পুজো দেওয়ার চার-পাঁচটা লাইন। CISF এর লোকেরা ভিড় আর জটলা দেখলেই চলে এসে খালি করে দিচ্ছে, সাহায্য তো করছেই প্রথমবার যারা এসেছে তাদের কোন লাইনে দাঁড়ালে একদম মায়ের সামনের দিয়ে পৌঁছে দর্শন করা যাবে, ভোগের কুপন কোথেকে আর কতক্ষণ পাওয়া যাবে; সবকিছুতেই।

ঠিক যেন একটা বিড়লা বা স্বামীনাথন মন্দিরে ঢুকেছি।

না পাওয়ার কষ্টটা এখান থেকেই শুরু!

কিছু জিনিস যেমন পুরনো হয় না তেমনি কিছু জায়গা পাল্টে গেলে পুরনো স্মৃতি মনে পড়তে বাধ্য। দক্ষিণেশ্বরও ঠিক তেমন।

জন্মের পর থেকে বছরে একাধিকবার যাওয়ার সূত্রে আজো চোখে ভাসে গেটের ভেতর ঢুকতেই একাধিক না খেতে পাওয়া মানুষের বসে থাকা একমুঠো খাবারের প্রত্যাশায় অথবা কিছু টাকার জন্যে। সেই সংখ্যা কমতে কমতে আজ তলানিতে এসে ঠেকেছে। মনে পরে যায় দুপাশের সেই খেলনা আর আচারের দোকানগুলো। নতুন জায়গায় একটাই আচারের দোকান দেখলাম আর গুটিকয়েক খেলনা, ফটো আর শাঁখের দোকান। বাকিরা হয়তো প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ছিটকে গেছে।

খাবারের দোকানে সেই গরম হিংয়ের কচুরির ডাক আর নেই, বরং নতুন মেনু কার্ডে কচুরি শেষের দিকে; সিঙ্গারার একটু ওপরে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রথম সারিতে দোসা, ইডলি আর ছোলে বাটুরে। কমলাভোগ হালকা হতে হতে প্রায় সাদা আর ল্যাংচা ইঁটের থেকেও শক্ত।

এ তো গেলো বাইরের কথা, মন্দির চত্বরে ঢুকে আপনি যদি ভাবেন একটু গঙ্গার দিক থেকে ঘুরে আসবেন বা ঠাকুমা বলছে স্নান করে এসে পুজো দেবে (যদিও এখনকার ঠাকুমারা গঙ্গা ছেড়ে সুইমিং পুলে বেশী স্বচ্ছন্দ), সে গুড়ে বালি। শেষবার ওদিক দিয়ে কড়া পুলিশি পাহারায় স্ক্যান করে ঢুকতে দিয়েছিল, এবার সেটাও বন্ধ। গঙ্গার পাড়ে বসে আড্ডা দিতে দিতে বাদামভাজা খাওয়ার দিন তো কবেই শেষ হয়ে গেছিল, এবার গঙ্গা দর্শন (সাথে বালি ব্রিজ আর নিবেদিতা সেতু ফ্রি) করতে হলে ঘুরে আসতেই হবে আপনাকে।

শিবমন্দিরের ভেতরে ঢোকা বারণ সেটা বারবার করে মাইকে বলা হচ্ছে। ধূপকাঠি আর মালাও চিরতরে হারিয়ে গেলো কালের নিয়মে। পঞ্চবটী এখন বড্ড নিঃসঙ্গ; বেশিরভাগ বাঁদরই তল্লাট ছেড়ে চলে গেছে। মাঝখানে যেখানে নানা রকমের জিনিস পাওয়া যেত সেটা এখন গাছ পুঁতে লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা।

বড্ড অসহায় লাগছিল যে তিনঘণ্টা ওখানে ছিলাম। হাজার হাজার মানুষের সুবিধা হয়েছে লাইন ধরে আসা যাওয়ায়, একই জায়গায় জুতো রেখে পুজোর ডালা নিয়ে পুজো দেওয়া আজ অনেক সংঘবদ্ধ, খাওয়ার অপশন অনেক বেশি সবার জন্যে। মানুষ যন্ত্রের মতো এগিয়ে চলেছে মূল মন্দির থেকে নাটমন্দিরে, বারো শিবের মন্দির থেকে রাধাকৃষ্ণ অব্দি।

সবকিছুই আছে, হয়তো আগের থেকেও ভালো; কিন্তু দক্ষিণেশ্বরই যে হারিয়ে গেছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.