এই লেখার একটা প্রাককথন আছে। যদিও আমার প্রধান বিচরণ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে নয়, তবুও ছোটবেলা থেকে সাংগীতিক পরিমণ্ডলে বড় হওয়ার সুবাদে খুব কাছ থেকে শাস্ত্রীয় এবং অ-শাস্ত্রীয় সবরকম গান শুনেছি। ফলতঃ, গানের প্রতি ভালোবাসা ফল্গুর মতন বয়ে চলেছে নিরন্তর অন্তরে। সেটার বহির্প্রকাশ ঘটার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায় ফেলোশিপ এর কল্যাণে। পড়াশোনা করা ছিল, সেগুলো পরপর শব্দের আকারে সাজিয়ে দিলাম। আরও অনেক কিছু হয়তো বলা যেত, মনের মধ্যে ‘শেষ হইয়াও হইল না যে শেষের’ একটা রেশ থেকে গেলো – এটা বেশ অস্বস্তির, তবে স্বল্প পরিসরে এইটুকুই থাক। বাকিটা নাহয় উৎসাহী পাঠক শেষ করবেন।
কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন শ্রী মনসিজ বন্দোপাধ্যায়, তিনি জোর না করলে এই বিষয় নিয়ে লিখতে বসতাম না ওনার ‘মনফকির’ কাগজের জন্যে।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত ও অতুলপ্রসাদ – পঞ্চকবির কাজের অনেকটাই আমাদের জানা। তাই ফিরে যাই ঠিক তার আগের সময়ে। বাংলা তথা ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসের শিকড় মাটির অনেক নিচে পৌঁছে গেছে। সেখান থেকে পাঠকের সামনে কিছু তুলে আনার সামান্য প্রচেষ্টা, খননকার্যের মাধ্যমে।
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন কাল থেকেই সঙ্গীতের দুটি ধারা – মার্গসঙ্গীত আর দেশীয় সঙ্গীত। আমরা যাকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা রাগসঙ্গীত বলি, সেটা মার্গসঙ্গীতকে অনুসরন করে। দেশীয় সঙ্গীতে কথা ও সুরের প্রাধান্য দেখা যায় আর মার্গসঙ্গীতে রাগের বিস্তার আর সুরই প্রধান – কথার বৈচিত্র্য অনেক কম। যদিও বাংলার সঙ্গীত দেশীয় ধারায় বেশী প্রবহমান, কিন্তু শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অবদানও অস্বীকার করা যায় না। বাংলা ভাষার সঙ্গীতের সূত্রধর চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয় নামে এক প্রাচীন পুঁথি। খ্রিস্টীয় নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে এই ৪৭ টি গান রচিত হয় যাকে আজকের বাংলা গানের মূল ভিত্তি বলে ধরা হয়।
চর্যাগীতি আসলে বৌদ্ধ সহজিয়াদের সাধনার গান। পাল রাজারা এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে এই গানের বিশেষ ভুমিকা ছিল। এখন আমরা যাকে গানের কলি বলি, যেমন স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ, সেকালে ছিল চার ধাতু – উদ্গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব ও আভোগ। প্রবন্ধগীত বলে পরিচিত এই সব সঙ্গীতে উদ্গ্রাহ ও ধ্রুব থাকতোই, বাকিরা না থাকলেও চলে। বেশ কিছু রাগের নাম ও পাওয়া যায় যাদের ওপর ভিত্তি করে চর্যাগীতি গাওয়া হত, যেমন – ভৈরবী, কামোদ, মল্লার, গুর্জরী, অরু, বঙ্গাল, ইন্দ্রতাল ইত্যাদি। সাথে সঙ্গতে থাকতো একতারা আর ঢোল।
চর্যাপদের সমসাময়িক নাথগীতি যা গোরক্ষনাথের প্রতিষ্ঠিত এবং নাথ গুরুদের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে। নাথগীতির দুটি ভাগ – একটিতে গোরক্ষনাথ ও তার গুরু মীননাথের কাহিনী আর অন্যটিতে গোপীচন্দ্র, মানিকচন্দ্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথমটি গোরক্ষবিজয় আর দ্বিতীয়টি ময়নামতীর গান বলে বেশী পরিচিত। নাথগীতি সম্ভবত পড়া হত ছড়ার আকারে, পাঁচালির সুরে।
বাংলাভাষায় সঙ্গীতের নবজাগরণ আনে জয়দেবের গীতগোবিন্দ। রাধাকৃষ্ণের লীলাকে কেন্দ্র করে রচিত গীতগোবিন্দে কলির উপস্থিতি এক অন্য মাত্রা আনে। ২৪টি গান গাওয়া হত একতাল, রূপক আর অষ্টতালে। পটমঞ্জরী, ভৈরবী, বিভাস, বসন্ত, দেশ, রামকিরি, ইত্যাদি রাগমালা ছিল এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। গীতগোবিন্দ সাধারনত ধ্রুপদাঙ্গেই গাওয়া হত, পরবর্তীকালে শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে কীর্তনে পরিণত হয়। ঠিক একইসাথে উচ্চারিত হয় বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। দুটি গোপ বালক –বালিকার প্রেমের সাথে সাথে তৎকালীন গ্রাম্য জীবনের এক ছবি ফুটে ওঠে। রাগ ও তাল গীতগোবিন্দের সাথে মিলে যায়, তবে পাহাড়ি রাগের আধিক্য বেশী এখানে। পরবর্তীকালে ঝুমুর গানের অনুপ্রেরণাও এই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন।
বাংলা গানের কথা হবে আর সেখানে বিদ্যাপতির বৈষ্ণবপদাবলী থাকবে না, সেটা কি হয়? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যেখানে তাঁর বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। মৈথিলী ভাষায় রচিত বৈষ্ণবপদাবলীতে মানবিক প্রেম আর ভক্তিরসের মিশ্রন লক্ষ্য করা যায়। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা বৈষ্ণবপদাবলীর প্রধান অবলম্বন। এর প্রচারে শ্রীচৈতন্যর অনেকখানি অবদান আছে। নরহরি দাস, জ্ঞানদাস, চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, মালাধর বসু প্রমুখরা ছিলেন বৈষ্ণবপদাবলীর শ্রেষ্ঠ পদকার। শ্রীচৈতন্য কীর্তন গানকেও পাদপ্রদীপের নিচে আনেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায়। ঈশ্বরের নামগানই ছিল কীর্তন যাকে চৈতন্যদেব দুটি ভাগে ভাগ করেন – লীলা কীর্তন আর নাম সংকীর্তন। এখনকার গানের মতই কীর্তন প্রথম থেকেই চার কলিতে বিন্যস্ত। বাংলার ঘরে ঘরে একসময় কীর্তন শোনা যেত। কীর্তন ভেঙ্গেই তৈরি হয় ঢপ কীর্তন। পাঁচালী আর যাত্রার গানের অনেক প্রভাব ঢপ কীর্তনে পাওয়া যায়।
মধ্যযুগে কীর্তনের সময়কালে উঠে আসে মঙ্গলকাব্য, পাঁচালি আর শাক্তগীতি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য রায়গুনাকর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল ও দাশরথি রায়ের পাঁচালী। শাক্ত সঙ্গীত এবং উমা সঙ্গীত যা আগমনী – বিজয়া বলে পরিচিত, সেই গানেও শক্তি বা দেবীর আরাধনা করা হয়। সাধক রামপ্রসাদের নাম আমরা সবাই জানি। সাথে ছিলেন কমলাকান্ত ভট্টাচার্য। দুজনের এবং পরবর্তীতে আরও অনেকের ভক্তিমূলক শ্যামাসংগীত আমাদের মন ছুঁয়ে যায়।
প্রাচীন বাংলায় খুব জনপ্রিয় ছিল যাত্রাগান আর কবির লড়াই। ভোলা ময়রা আর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গীর কবির লড়াই তো সর্বজনবিদিত। আঠারো–উনিশ শতকের দিকে কবিগানের উন্মেষ হয়, কবিয়ালরা প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও চটজলদি সামাজিক আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কথায় সুর বসিয়ে গাইতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। মূলত রাজসভায় প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্যে কবিয়ালদের গানের প্রশ্নোত্তর বা চাপান ও উত্তর রচনা করতে হত। গোঁজলা গুঁই নামের কবিয়ালকে সবার গুরু ধরা হয়। একে নাম করেছিলেন কবি রঘুনাথ, লালু, হরু ঠাকুর, নিতাই বৈরাগী প্রমুখ। ভোলা ময়রা আর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী বাদে রাম বসু ছিলেন বেশ নামকরা। কবিয়ালদের কালিদাস বলা হত তাকে। কবিগানের ভিন্ন একটি রূপ লক্ষ্য করা যায় বয়াতিদের গানে। যারা গানের ভেতর দিয়ে বয়ান করেন এবং প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ভাববিনিময় করেন তাঁদের বলা হয় বয়াতি। বাংলাদেশের কিছু বিখ্যাত বয়াতি হলেন আবদুর রহমান, কুদ্দুস বয়াতি, ইদ্রিস বয়াতি প্রমুখ। তারাশঙ্করের কবি উপন্যাস এই কবিয়াল আর বয়াতিদের জীবনধারার উত্তর বাহক। তুলনায়, যাত্রা গানের ব্যাপ্তি ছিল সমাজের সমস্ত শ্রেণীতে। গ্রামে গঞ্জে যাত্রার শুরু শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মনসামঙ্গলের হাত ধরে। পুরাকালে যাত্রায় সংলাপ থাকলেও গানের প্রাধান্য বেশী ছিল। পদ্গুলি এমনভাবে সাজানো হত যাতে গানের মাধ্যমে গল্প এগিয়ে যায়। গোবিন্দ অধিকারী, নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণকমল গোস্বামীর বেশ নামডাক ছিল। জনপ্রিয় পালার মধ্যে ছিল নৌকাবিলাস, কংসবধ, চন্ডালিনী উদ্ধার, স্বপ্নবিলাস ইত্যাদি। বাংলার বাইরের মানুষ অথচ বাংলার মন জয় করে নিয়েছিলেন এমন একজন হলেন উড়িষ্যার গোপাল উড়ে। বিদ্যাসুন্দর পালার যাত্রার গানে আড়খেমটা রীতি প্রচলন করে মাতিয়ে রাখতেন জনগণকে।
বাংলায় প্রথাগতভাবে গুরু-শিষ্য পরম্পরা আসে বাউল গানের হাত ধরে। মাধববিবি এবং আউলচাঁদের মাধ্যমে এর সূচনা। একে পূর্ণতা পায় নিত্যানন্দ, বীরভদ্র বাউল, কাঙাল হরিনাথ, লালন ফকিরের মাধ্যমে। পরবর্তীতে বাউল ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যান গগন শাহ্, দুদ্দু শাহ, ভবা পাগলা, হাসন রাজারা। রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মধর্মের উপাসনার অঙ্গ হিসেবে ব্রহ্মসঙ্গীতের উদ্ভব, প্রধানত খেয়াল আর টপ্পার ওপর ভিত্তি করে ব্রহ্মসঙ্গীত তৈরি করতেন বিষ্ণু চক্রবর্তী, কৃষ্ণপ্রসাদ চক্রবর্তীরা।
শেষ করব নিধুবাবুর টপ্পা দিয়ে। যদিও টপ্পা আসলে পাঞ্জাবের লোকসঙ্গীত, ঠিক যেমন আমাদের বাউল, ভাটিয়ালি, সারি, জারি, মুর্শিদি ইত্যাদি। বিভিন্ন রাগের ওপর তৈরি টপ্পা খুব দ্রুত মানুষের মন জয় করে নেয়। বাংলা টপ্পায় রামনিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু পাঞ্জাবের সুরের ছোঁয়া রাখলেও তানের গতি কমিয়ে আনেন। ওনার পদাঙ্ক অনুসরন করে শ্রীধর কথক, কালী মির্জা, হস্নু মিঞারা বিভিন্ন আঙ্গিকে টপ্পা গান তৈরি করে গেছেন যা পরবর্তীকালে নানা সময়ে নানা রূপে ব্যবহৃত হয়েছে।
আগেই বলেছি, পঞ্চকবির কাজের সালতামামীর জায়গা এটা নয়, তার আগের সময়কে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলা লোকসাহিত্যে পালারীতির প্রচলন সার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে মৈমনসিংহ–গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ–গীতিকায়। এগুলি বাংলা সাহিত্য–সঙ্গীতের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এর বাইরে আরও অনেক গানের ধারা আছে, সময় সুযোগে আলোচনা করা যাবে। সঙ্গীতের অনেক ছাত্রের এই ইতিহাস হয়তো আগে থেকেই জানা, কিছু মানুষ হয়তো প্রথম শুনলেন অনেক কিছু। উত্তরকাল এনাদের মত দিকপালদের বাঁচিয়ে রাখুক আর সঠিক মূল্যায়ন করুক, এটাই কাম্য। আমাদের শিকড়কে যেন কোনোভাবেই আমরা ভুলে না যাই। তাহলেই এই লেখার সার্থকতা।