তখন গ্রামাফোন রেকর্ড এর সময়। বাড়িতে একটা HMV Safari রেডিও কাম গ্রামাফোন প্লেয়ার ছিল, রবীন্দ্রনাথ এর সাথে আমার আলাপ তার মাধ্যমেই। আজ মনে পড়ে না, প্রথম কোথায় শুনেছিলাম রবীন্দ্রসংগীত কিন্তু সেটা যে সত্যিই কানের ভিতর দিয়ে মরমে পৌঁছেছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পড়াশোনার সাথে সাথে সকালে আর দুপুরে কলকাতা “ক” এর রবীন্দ্রসংগীত শোনা ছিল দৈনন্দিন কাজ, এভাবেই গুনগুন করতে শুরু করলাম একের পর এক ভালোলাগা গান। বেশ মনে পড়ে প্রথম পুরো গাইতে পারতাম “পুরানো সেই দিনের কথা” গানটি, অবশ্যই বেসুরো গলায়। একে একে “মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলে”, “মম চিত্তে নিতি নৃত্যে” এবং আরও অনেক গান। সমবয়সী ছেলেমেয়েরা যেখানে “আমরা সবাই রাজা” গাইত, তখন আমি শুনে ফেলেছি, রাজ্যেশ্বরী দত্তের গলায় “যে রাতে মোর দুয়ারগুলি”। একটা সাংগীতিক পরিমণ্ডল আর অনেক গান শোনাই হয়তো এর মূল কারন।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়ার আগেই আমার গান শোনা, আলাপ বাড়িতে থাকা হেমন্ত, কনিকা, সুচিত্রা, সাগর সেন আর দেবব্রত বিশ্বাসের রেকর্ডের সাথে। বাবা গীতিনাট্য ভালবাসতেন, তাই খুব ছোটবেলাতেই কানে বাজত “শ্যামা”, “শাপমোচন”, “মায়ার খেলা”, “চণ্ডালিকা”। হয়তো সেই শোনার রেশ আজো থেকে গেছে বলে একটু সুরের বিচ্যুতি হলেই কানে বাজে, মনে হয় যেন সরে এলাম মূল ধারা থেকে। একটা সুবিধে ছিল, রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতাই গান হয়েছিল আর অনেক গানই কবিতা করে পড়া যেত, তাই বারবার শোনার ফলে মনে রাখা সহজ ছিল। সাথে মা যখন সন্ধ্যাবেলা রেওয়াজ করতে বসতেন, তখন অনেক গানের মধ্যে শুনতে পেতাম “অরূপ তোমার বাণী”, “সখী ভাবনা কাহারে বলে” ইত্যাদি মন ছুঁয়ে যাওয়া গান।
কিছু গান যেন কিছু শিল্পীর গলায় না শুনলে মনটা কিছুতেই ভাল হত না। সুচিত্রা মিত্রর “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি”, হেমন্তর “অমল ধবল পালে”, সাগর সেন এর “আজি শুভদিনে পিতার ভবনে”, কনিকার “দূরে কোথায় দূরে দূরে”, এমন অসংখ্য সব গান। ছিলেন মায়া সেন, সুমিত্রা সেন, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে। ভাল লাগত কিছু ব্যতিক্রমী গলার গান, যেমন কিশোর কুমার, পীযূষ কান্তি সরকার। পরবর্তী কালে মোহন সিংহ, সুমন চট্টোপাধ্যায় (কবীর সুমন), শ্রাবণী সেন, স্বাগতালক্ষ্মী, শ্রীকান্ত আচার্য এবং আরও অনেকে। গীটারে বটুক নন্দীর মিষ্টি আওয়াজ মাঝে মাঝেই শোনা যেত সাথে ভি বালসারা’র অর্গানের সিম্ফনি।
কথায় বলে, গানের কোন ভাষা নেই। তাই ছোটবেলায় মানে না বুঝে শোনা অনেক গান আজো রয়ে গেছে মনের মণিকোঠায়। পরে বাবার থেকে শিখেছিলাম, গানের মানে বুঝতে – তবেই না মণিমুক্তো আহরণ করতে পারা যাবে। সেই চেষ্টা আজো করে যাই, পুরনো গানও নতুন অর্থ আনে। আসলে রবীন্দ্রসংগীত তো শুধু গান নয়, যেন একটা আস্ত জীবনদর্শন যেখানে সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, বিরহ, অভিমান, ভালোবাসা আর ভালোলাগা মিলেমিশে এক হয়ে যায়।
Great work