ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ

সবাই যখন কা করু সজনী আয়ে না বালম অথবা ইয়াদ পিয়া কি আয়ে শুনে ফেলেছে আমি তখনও আটকে ছিলাম দরবারী কানারাতে। এর আগে আমীর খাঁ সাহেবের দরবারী শুনেছি কিন্তু এটা কি শুনলাম? ঠিক যেন টেস্ট ম্যাচ থেকে সোজা টি টোয়েন্টির যুগে এসে পড়ে গেলাম। তবে টি টোয়েন্টি বললাম বলে আবার ভাববেন না যে অনেক কিছুই পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন শিল্পী। সেটা তো নয়ই কিন্তু ওই আওয়াজটার কোথায় যেন একটা অভাব ছিল। পাশের বাড়ির ছেলে হয়ে অনেকদিন থাকা একটা রাগ যৌবনের দূতও যে হতে পারে, এই দরবারী সেই সাক্ষ্য বহন করে।

সেই প্রথম শুনলাম ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর মেঘগর্জন কণ্ঠে দরবারী কানারা। আজও মনে আছে সেটা ঘটনাচক্রে ছিল মাঝরাত আর সারারাত আমি ওই একই রাগ শুনে গেছি যতবার পেরেছি। ওস্তাদই বটে।

অনেকেই জানেন আমার প্রিয় রাগ, দেশ বা দেশী। কারণ জানিনা, হয়তো খুব সোজা চলন যেটা শিশুমনে দাগ কাটতেই পারে সেটা একটা বড় ফ্যাক্টর ছিলো। পরবর্তীকালে রাগেদের শ্রেণিবিভাজন করতে গিয়ে দেখেছি, দরবারী কানারাকে একদম ওপর সারিতে না রাখার কোনো কারণই নেই। যদিও এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত; গান আমি গাইতে পারি না আর গান বোঝাটাও একেবারেই চানঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

যাই হোক, রেকর্ড-ক্যাসেট-সিডিতে যেখানে যত বড়ে গোলাম আলী খাঁ আছেন, শুনে ফেলা হলো। আজও মনে আছে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের রাগাশ্রয়ী বাংলা গানের ক্যাসেটের বিনিময়ে অনেক কষ্টে জোগাড় করেছিলাম রাগ টোডি, পরে অবশ্য সন্ধ্যার ওই ক্যাসেটটাও কিনে নিয়েছিলাম যেটার পরতে পরতে জড়িয়ে ছিলেন খান সাহেব, আমীর খাঁ আর জ্ঞানবাবু।

মামবাড়ির দাদুর কথা অনেকবার বলেছি, আমার রাগমালা সিরিজে তাঁর উল্লেখও আছে। সামান্য একটা পোস্ট অফিসে চাকরি করে কিকরে অতবড় একটা সংসার টানতেন সেই রসায়ন আজও আমার অজানা। সাথে গান বাজনার ওপর অগাধ ভালবাসা। নিজে ভালো বেহালা বাজাতেন, নিয়মিত সঙ্গত করতেন ভি জি যোগ সাহেবের সাথে; ভাই তবলা বাজাতেন, মেয়ে (ঘটনাচক্রে আমার মা) আর কিছুদিনের মধ্যেই তখন রেডিওতে গাইবেন – এত সব কিছু সামলানো মুখের কথা নয়। সেই দাদুর গানের যে খাতায় পাতায় পাতায় শুধু শিল্পীদের ছবি থাকতো সেখানেই দেখি খাঁ সাহেবের চাচা ওস্তাদ কালে খাঁকে। দাদুর কাছেই শোনা সুরমণ্ডলের মতো যন্ত্রকে কিকরে নবজন্ম দিয়েছিলেন ওস্তাদজী আর কীভাবে ঠুংরি টপ্পাকে মিলিয়ে দিয়ে তৈরি করেছিলেন এক নতুন আন্দাজ।

এতো রাগ এতবার শুনেছি খাঁ সাহেবের গলায় যে নতুন করে কোনো একটা রাগের সম্পর্কে বলা মানে আমার জ্ঞানের দীনতা আরো প্রকাশিত হবে। সচেতনভাবেই সেটা চাই না। পিলু, তোডী, ইমন, ভীমপলশ্রী, ভৈরবী, মেঘমল্লার – আর কত বলবো যেগুলো শুনলে আজো শরীরে কাঁটা দেয়। এগুলোর মধ্যে আমার ব্যক্তিগতভাবে বেশী পছন্দ রাগ মালকোষ। সাথে সবগুলো ঠুমরীই অসাধারণ, এখনও শুনি সময় পেলেই। পরবর্তীকালে জেনেছি তিনি কলকাতা আর হায়দ্রাবাদ – এই দুই জায়গাতেই থাকতে খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন (বম্বে ছাড়া) আর আমিও ঘটনাচক্রে এই দুই জায়গাতেই অনেকটা সময় কাটিয়েছি।

ডাইরেক্ট শিষ্য শিষ্যা দের মধ্যে সামনে বসে প্রসূন ব্যানার্জী, মীরা ব্যানার্জী আর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। দুটো সাধ অপূর্ণ আছে, আশা করি খুব তাড়াতাড়ি সেগুলো পূরণ করে ফেলব। এক হলো খাঁ সাহেবের সর্বকনিষ্ঠ শিষ্যা প্রভাতীদির সামনে বসে কিছু কথা আর গান শোনা (এবারের কলকাতা ট্যুরেই সেটা হয়ে যেত, বাবার অসুস্থতাজনিত কারণে আর বেরোতে পারিনি) আর দ্বিতীয়, আমার বর্তমান কর্মস্থল হায়দ্রাবাদে ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর শেষজীবনের দিন-ক্ষণ-স্থান নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা।

কি করবো, লাল হলুদ সুতোর গাণ্ডা বাঁধার সৌভাগ্য তো হয়নি, তাই বলে গুরুদক্ষিণা দেবো না সেটা তো আর হয় না। এটাই না হয় হোক কোনো এক একলব্যের নজরানা!!!!

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ এক অগ্রজ সাংবাদিক গৌহাটি থেকে পাঠিয়েছিলেন প্রায় বছর দশেক আগে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.