বিশ্বরূপ মহারাজ

চাকরী জীবনের একদম প্রথম দিক, webel এ কাজ করছি মাস্টার্স শেষ করে। সাথে বড় হওয়ার জন্যে আরো কিছু পড়াশোনা করছি। হঠাৎ একজন খবর দিলো, শনি ও রবিবার কম্পিউটার শেখাতে হবে রামকৃষ্ণ মিশন বেলঘড়িয়াতে। ইন্টারভিউতে পাশ করলে তবেই মিলবে সুযোগ। কোনোভাবে সময় বের করে bio data জমা দিয়ে এলাম, একদিন খবর এলো ইন্টারভিউ এর। আজ এতো বছর পরেও স্পষ্ট মনে আছে, দু’জন মহারাজ ছিলেন, সাথে প্রধান সুব্রত মহারাজ আর পলিটেকনিক কলেজের প্রিন্সিপাল স্যার। দেড় ঘন্টা পরে বেরিয়ে এসে মনে হয়েছিলো সবার মধ্যে চাকরিটা আমিই পাবো। তাই হয়েছিলো। হয়তো অর্থের থেকে সম্মানটা বড় ছিল বলেই এই ধারণা হয়েছিলো। সেদিনই সবার ইন্টারভিউ শেষ হলে আমি সুখবরটা নিয়ে বাড়ি এসেছিলাম। অর্থমূল্য সামান্য কিন্তু আমার কাছে মিশনের সাথে যুক্ত হওয়াটাই এক বিশাল প্রাপ্তি!

প্রথম দিনই আলাপ তাঁর সাথে, কম্পিউটার ল্যাব এর চাবি আনতে গিয়ে। সাদা বাড়িতে বসে মুড়ি বাতাসা খাচ্ছিলেন, sridhar দাকে বললেন আর একটা বাটি আনতে, নিজের হাতে দিলেন মুড়ি আর বাতাসা। নাম, ধাম জিজ্ঞেস করতে করতে বললেন, মুড়ি খাও। আন্তরিকতার শুরু সেখানেই আর শেষ ‘তুই’ তে। সে একটা লম্বা ইতিহাস।

কিছু মানুষ জীবনে আসেন অন্যকে বড় করতে, আর সন্ন্যাসীদের তো সেটাই ব্রত। তিরিশ না হওয়া একটা ছেলের সামনে উনি খুলে দিলেন এক নতুন জানলা। সেই শুরু, তারপর কবে শনি আর রবিবার পেরিয়ে আমি এক ঘণ্টার জন্যে হলেও তাঁর সাথে সোম থেকে শুক্রবার দেখা করতে গেছি সেটা আমি নিজেও জানি না। হাতে তুলে দিয়েছিলেন তার এবং মিশনের লাইব্রেরীর চাবি, যখন তখন যতো খুশী বই নিয়ে পড়ে আবার ফেরত দেওয়ার জন্যে। কোনোদিন জানতে চান নি কয়টা বই নিয়েছি, অথচ সেই সব বই থেকেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন আমি আদৌ পড়েছি কিনা সেটা বোঝার জন্য। কিছুদিনের মধ্যেই যখন অনেকগুলো বিদেশী পরীক্ষায় সফল হয়ে খবর দিতে ছুটে ছিলাম, নিজে হাতে বসে খিচুড়ি খাওয়ালেন পাশে বসিয়ে। মানুষের জন্যে কিছু করব এটা বোধহয় সেদিনই রক্তে ঢুকে গেছিল, আজও চেষ্টা করি নীরবে কিছু করার।

একবার খবরের কাগজ থেকে রিপোর্টার এসেছেন মিশনের কিছু ব্যাপারে প্রতিবেদন প্রকাশ করবে। বাদল মহারাজ থেকে সুব্রত মহারাজ সবাই দেখলাম একটা বিষয়ে স্থির – তাঁদের ছবি যেন না আসে কাগজে। পরের দিন কাগজে অনেক কিছু বেরোয়, সাথে মিশনের, কলেজের আর কিছু আবাসিকদের ছবি! নীরবে কাজ করার অনুপ্রেরণা এখান থেকে না এলে আর কোনোদিনই আসবে না।

দু’বছর লাগলো এই ধাক্কা সামলাতে আর কিছু একটা লেখার মতো জায়গায় আসতে। অনেক স্মৃতি ভিড় করে আসে মনে একের পর এক, মানুষটা তেমনই ছিলেন। সব হয়তো সাজানোও সম্ভব না, যেটুকু পারা যায় ওই ছোটো চেহারার অথচ অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর মানুষটিকে ধরে রাখার! সন্ন্যাসীদের আগের কথা বলতে নেই, তাই অনেকটা জেনেও আমি বলবো না তার পূর্ব জীবনের কথা।

একদিন হঠাৎ ফোন এলো বিকেলে, আমি দার্জিলিং এ চলে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে দেখা করে যা। গেলাম অফিস ফেরত, অনেক গল্প হলো যথারীতি। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সবচেয়ে বেশী Tech Savvy ছিলেন, কম্পিউটারে ছিল অগাধ জ্ঞান আর স্মার্ট ফোনের সাথে থাকতো একটা iPad. ছিল সব কিছু জানার ইচ্ছে যেটা আমার মতো একজন সাধারণ ছেলেকে শিখিয়ে দিতো যে প্রশ্ন করলে তবেই কোনো জিনিস জানা যায়। মনে পড়ে, যখন কথা বলতেন, টেবিলের ওপর দুটো হাত সমান্তরাল ভাবে রাখতেন, আর রাস্তায় হলে হাত দুটো পেছনে। কত অবলীলায় কাঁধে হাত দিয়ে বলতেন, চল পাগলা পুকুরের দিকে; মাছ ধরবো। মানুষের সাথে মিশে যাওয়াটা ছিল জলভাতের থেকেও সোজা। পরবর্তীকালে দার্জিলিং এ গিয়ে দেখেছি জেলাশাসক থেকে ভুটিয়া ছেলে – সবাই ভালোবাসতো এই মানুষটিকে।

দার্জিলিং এর কথায় মনে পড়লো, একদিন অফিসে বসে আছি; প্রথমে whatsapp তার সাথে সাথেই ফোন। কিরে, ব্যস্ত আছিস? ছিলাম, তবু বললাম, না না, মহারাজ; বলুন।

শোন না, আমার এই দার্জিলিং এর Roy Villa এর একটা history লিখে দিতে হবে তোকে, সাথে নিবেদিতা। তোর বাংলা আর ইংরেজি সব লেখা আমি পড়ি, তুইই পারবি এটা। ছবি সব আমি তোকে মেইল করে দিয়ে দেবো।

এক নিঃশ্বাসে এত কিছু বলে উনি থামলেন। যথারীতি আমার না বলার কোনো জায়গা নেই, আর সেই সুযোগও আমায় তিনি দেন নি। আমি খুব একটা ক্ষীণ কন্ঠে তবু বলার চেষ্টা করলাম, এটা কি আমার দ্বারা হবে?

পরিষ্কার বলে দিলেন, উইকিপিডিয়ার Roy Villa র English আর বাংলা পেইজ তুই বানাবি আর লিখবি। কিছু ভুল হলে আমি ঠিক করে দেবো।

যথা আজ্ঞা মহারাজ।

আজও উইকিপিডিয়া তে আমার নাম যখন Roy Villa র সাথে সমান ভাবে উচ্চারিত হয়, নিজে দেখি সেই নাম বারবার; জানি তার বিন্দুমাত্র কৃতিত্ব আমার নয়! আমায় দিয়ে উনি একটা মহৎ কাজ করিয়ে নিয়েছিলেন মাত্র। জীবনে পূন্য অর্জন বোধহয় এভাবেই হয়।

ক্রমে কলকাতা ছেড়ে বাইরে বেরোলাম, প্রথমবার bangalore যাওয়ার আগে আশীর্বাদ নিতে গেছিলাম। সেই অন্য অননুকরণীয় ভঙ্গিতে দু’হাত বাড়িয়ে বলেছিলেন, ওরে প্রণাম না, বুকে আয়। অনেক বড়ো হবি জীবনে, মিলিয়ে নিস। বড় হতে পারিনি, কিন্তু আশীর্বাদ চেটেপুটে নিতে আপত্তি কোথায়?

কথা বলতেন যদি কিছু ছেলের চাকরির ব্যবস্থা করা যায় বাংলায় বা বাইরে। নিজের সামর্থ্যে চেষ্টা করেছি সামান্য। কতজনকে জীবনের দিশা দেখাতে পেরেছি জানিনা, তবে খালি হাতে কাউকে ফেরাই নি। আর ওঁর শিক্ষাতেই সেটা কাউকে বলে নাম কেনার চেষ্টা সেদিনও করিনি, আর আজ তো প্রশ্নই ওঠে না।

গুরু তিনিই হন যিনি পথ দেখান। সে মা অথবা বাবাও হতে পারেন কিংবা বাইরের কেউ। বিশ্বরূপ মহারাজ আমায় বিশ্ব দর্শন করিয়ে ছিলেন। শিখিয়ে ছিলেন অনেক অনেক কিছু, এই ব্যর্থ জীবন তার সিকিভাগও কাজে লাগাতে পারেনি। আশ্রমিক না হয়েও, আবাসিক না হয়েও যে ভালোবাসা উনি দিয়েছিলেন, তার তুলনা তিনি নিজেই।

শেষ করব অনেক ঘটনার মধ্যে সেরাটা দিয়ে। গরম কাল, সাইকেল চালিয়ে সবে পৌঁছেছি মিশনের সাদা বাড়িতে। দেখেই বললেন, কিরে ব্যাটা, ডাব খাবি? কিছু বলার অবকাশ না দিয়েই টেনে নিয়ে চললেন workshop এর দিকে। আজও ভুলবো না বছর পয়তাল্লিশের এক সন্ন্যাসী দড়ি নিয়ে নারকেল গাছে তরতরিয়ে উঠছেন আর নিচে এক কিশোর দাঁড়িয়ে আছে ডাব কুড়াবে বলে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য যা না দেখলে বিশ্বাস হবে না। তারপর নিচে নেমে নিজের হাতে ডাব কেটে পরম মমতায় যখন আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন – নে, খা! আমি সাক্ষাত বিবেকানন্দের দর্শন পেয়েছিলাম সেদিন স্বামী নিত্যসত্যানন্দের মধ্যে দিয়ে।

এ ছিল এক পরম প্রাপ্তি যা আজও মনে করি বারবার। দার্জিলিং এ গেলে প্রথমে ভেবেছিলাম আর কোনো দিন Roy Villa তে যাব না, কেউ তো আসবে না গেটের কাছে দ্রুত পায়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরতে, কেউ তো এক বাটি মোমো নিয়ে এসে বলবে না – এটা খেয়ে দেখ, আশ্রমেই বানানো। পরে ঠিক করেছি, অবশ্যই যাবো। বিশ্বরূপ মহারাজ আমার জন্য ওখানে অপেক্ষা করে থাকবেনই থাকবেন!

ভাগ্যবান বিশ্বরূপ মহারাজ, ধ্যানের মধ্যেই রামকৃষ্ণলোকে যাত্রা করেছেন, ভাগ্যবান তারা যারা শেষ যাত্রায় দার্জিলিং এ পা মিলিয়েছিলেন, ভাগ্যবান স্বামী নিত্যসত্যানন্দ মহারাজ যিনি ঠাঁই পেলেন ভগিনী নিবেদিতার স্মৃতিধন্য স্থানেই। অভাগা আমরা যারা দূর থেকে সবকিছু দেখে গেলাম, অথচ কিছুই করতে পারলাম না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.