ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় ভোর সাড়ে চারটে। সরকারী বাস সবে চলা শুরু করেছে, মর্নিং ডিউটি যাদের তারা রেডি হচ্ছে। আমার পিসি যেমন পাঁচটার বাসে রোজ রামমন্দির যেতেন জালান স্কুলে পড়াতে। বড় রাস্তার ওপরে যাদের বাড়ি, তাদের এই সময়ে একবার ঘুম ভাঙতে বাধ্য। এর দায় একা শুধু রাস্তা, বাস আর মানুষের নয়; সাথে ছিলো আরো এক ঝনঝন শব্দ যা জানান দিতো – ভোর হলো।
এই আওয়াজের সাথে পরিচিতরা এতক্ষণে ধরে ফেলেছেন আমার ভণিতা। হ্যাঁ, ঠিকই বুঝেছেন – আপনার বাড়ির পাশের দুধের ডিপোর সামনে থেমেছে হরিণঘাটার গাড়ী। আমার মতো অনেককেই হয়তো সেই কাঁচের বোতল, ক্রেটের আওয়াজ, দুধের লাইন পুরোনো নস্টালজিয়ায় ফিরিয়ে দেবে।
আজন্ম বরাহনগরের বাড়িতে দেখে এসেছি দুধের কার্ড – একটা সাদা আর একটা লাল। আজ আর মনে নেই কোনটা কোন দুধের জন্য, কিন্তু একটা বয়সের পরে আমার ডিউটি ছিলো রোজ সকালে তিনটে বাড়ি পরে ডিপো থেকে ওই কার্ড দেখিয়ে কাঁচের বোতলে দুধ নিয়ে আসা। বহু বছর এর অন্যথা হয়নি।
দুধের ডিপোর দিদিমণিরা আমায় জন্মাতে দেখেছিলেন, তাই এক – দু’বার কার্ড নিতে ভুলে গেলেও দুধ দিয়ে দিয়েছেন; পরে আমি বা বাবা গিয়ে সই করিয়ে এনেছি। আবার বিকেলে কোনো দিদিমণির সাথে রাস্তায় হঠাৎ দেখা হলে গাল টেপা আদরও পেয়েছি।
এমনকি, আগের দিন দুধ কেটে ছানা হয়ে গেলেও নিয়ম ছিলো সেই ছানা ভর্তি দুধের বোতল নিয়ে ফেরৎ দেওয়া। বোতল কোনোদিন ভাঙেনি, তাই জানিনা কত টাকা দিতে হতো ভেঙে গেলে। মা রোজ বোতল সাবধানে ধুয়ে টেবিলের ওপর রেখে দিতেন। আর বাবা প্রতিমাসে টাকা দিতেন কার্ডটা রিনিউ করার জন্যে।
বোতলের ক্যাপ হতো লাল, সাদা, সোনালী এলুমিনিয়াম ফয়েলের, সেটা জমিয়ে কিছু একটা বানানো বোধহয় তখনকার সব বাচ্চারাই করেছে। সবচেয়ে কমন ছিলো ধুয়ে নিয়ে মুড়িয়ে কানের গোড়ায় ধরে এক অদ্ভুত আওয়াজ শোনা, যাকে আমরা বলতাম রাবণের চিতা।
আঠারো বছর পর যেদিন বরাহনগর ছাড়লাম, রোজকার রোজ কাঁচের বোতল জমা আর নেওয়ার নিয়মের মাঝে জানি না কি করে একটা বোতল এক্সট্রা হয়ে গেছিলো। অনেক বছর ধরে ওই বোতল দিয়েই কালীপুজোতে রকেট ছাড়তাম।
আমাদের ভাড়া বাড়ির ছাদ তখনও ভাগ হয়নি।