ঘুড়িটার পেছনে ছুটতে ছুটতে কখন যে মাঠের একদম শেষে পুকুরের পাড়ে পৌঁছে গেছি, বুঝতেই পারি নি। ঝপাং করে পানাপুকুরে পড়েছি, সাথে উঁচু করে ধরে থাকা পেটকাটি ঘুড়িটা। কোনোরকমে কাদা গায়ে উঠে কলের জলে গা ধুয়ে বাড়ি গিয়ে খুব মার খেয়েছিলাম বাবার হাতে। না, পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে ঘুড়ি ধরার জন্য নয়, মিথ্যে বলেছিলাম ঘামে ভেজা গা বলে। কোথায় কচুরিপানার একটা টুকরো লেগে ছিল, বুঝতে পারিনি। এই আমিই আবার ডাংগুলি খেলতাম খুব ভালো। পাড়ায় কেউ আমার সাথে এঁটে উঠতে পারতো না। ওরা বলত, ডাংগুলির টুর্নামেন্ট হলে আমি নাকি চ্যাম্পিয়ন হবই। ছোটবেলার সেই স্কিল আজ হারিয়ে গেছে।
সে তো আমি হকিও ভালো খেলতাম। বড় মাঠে যখন ফুটবল ক্রিকেট হতো না, আমি হকি খেলে বেড়াতাম। আসলে আমার প্রিয় ছিল ফুটবল, তাই হকি স্টিক নিয়ে ফুটবল এর মতই ড্রিবল করে বেরিয়ে যেতাম। কিন্তু আমার সত্যিকারের নাম ছিল ফুটবল খেলায়। পাড়ায়, স্কুলে আমার জায়গা বাঁধা, গোল করতে আমার জুড়ি ছিল না। এখন যেটাকে খেপ খেলা বলে, তখনও আমায় ভাড়া করে নিয়ে যেতো অন্য ক্লাব। জিতলে ঘড়ি, টাকা, বই দিত পুরস্কারে, সাথে কাপ। কাপটা ক্লাবের হাতে আর ঘড়ি, টাকা ওখানেই বিলিয়ে দিয়ে শুধু বইগুলো নিয়ে এসে ঠাকুমাকে দিতাম। এখনকার ঠাকুমারা আর গল্প বলে না।
পড়া আর খেলা ছাড়াও আমাদের ছেলেবেলা অন্য রকম ছিল। মা বাবাদের এত শাসন ছিল না, যতো আব্দার মায়েদের কাছে আর দাদাগিরি ফলানোর জন্যে তো যৌথ পরিবারের ছোটো ভাইবোনগুলোতো ছিলই। অনেকটা সবুজের মাঝে কাটানো আমাদের ছেলেবেলা সত্যি কত রঙিন ছিল – সে বিজয়াতে বন্ধুরা দল বেঁধে পাড়ায় নারকেল নাড়ু, মুড়কি, মোয়া খাওয়াই হোক কিংবা ম্যারাপ বেঁধে যাত্রা দেখা। বৃষ্টি পড়লে বাড়ির সামনের জমা জলে কাগজের নৌকা ভাসানো ছিল কাগজ না কাটার প্রথম পাঠ। আজ যখন স্কুলে ক্রিয়েটিভ ক্লাসে ওরিগামি শেখানো হয়, সেই ছোটবেলায় আমরা নৌকা, জাহাজ, এরোপ্লেন সব বানিয়ে ফেলেছি।
ঠাকুমার সাথে হাত মিলিয়ে ডালের বড়ি দিয়েছি, আচার বানিয়েছি, মশলা বেঁটেছি শিলনোড়াতে, সেই আমিই দুপুরে স্কুলে গোল্লাচোর আর বিকেলে পাড়ায় কুমিরডাঙ্গা খেলে তবে বাড়ি ফিরেছি। সীমিত সামর্থ্যে কেনা স্কুল গেটের বাইরে দাঁড়ানো চাচার হজমিগুলি, আলুকাবলি আর কারেন্ট নুন এর স্বাদ আর কোথাও পাইনি। বৃষ্টি পড়ছে বলে আজ স্কুল যাব না, লোডশেডিং এ হ্যারিকেন এর আলোতে পড়ব না এই স্বাধীনতাও তো ছিল, তেমনি ছিল প্রত্যেক শীতে ময়দানে মেলার মাঠে বাড়ির বানানো লুচি আলুর দম খাওয়ার আনন্দ।
কোথায় গেলো সেই ছেলেবেলা? এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলাম! টাইম মেশিনটা কে যেন বানিয়েছিল? খোঁজ নিচ্ছি।