খুব ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে বাজারের সবথেকে দামি দুটো জিনিস আসতো – চা আর চাল। আমাদের আশেপাশের সবাই যখন মিনিকেট খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতো, আমাদের বাড়িতে তখনই আসতো রত্না চাল। পরবর্তীকালে চামড়মনি, দুধেশ্বর, জিরাকাটি পেরিয়ে এসে এখন লক্ষীভোগের সময় চলছে। বাবার লজিক ছিল খুব সোজা – ভালো ভাত না হলে সাথে তরকারি, মাছ বা মাংসের স্বাদ ঠিকমতো খোলে না। বাংলার বাইরে কোথায় আর এই সব চাল, আর যদি পাওয়াও যায় তবে অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। সেই চেষ্টা যে করা হয়নি তা নয়, তবে একই চাল দু’তিন মাসের গ্যাপে পাওয়া বেশ মুশকিল। বাঁশকাটি পাওয়া যায় অবশ্য কিছু নির্দিষ্ট দোকানে। তাই ছোট্ট ছোট্ট hmt বা kollam এর সোনা মুসুরির ডালই ভরসা সারা বছরের জন্যে। এখন অবশ্য একটা দোকানকে ধরে বেঁধে বাঁশকাটির সবচেয়ে ভালো চালটা আনাচ্ছি, জানি না কতদিন এই স্বর্গে থাকতে পারবো। এখনও স্বাদগন্ধহীন তুলাইপাঞ্জি চালের শোক ভুলতে পারিনি।
ঠিক তেমনি চা – আমি আদতে কালো কফিপ্রিয় মানুষ হলেও সময় বিশেষে চা-খোর হয়ে যাই। বেশ মনে আছে, ছোটবেলায় একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে এমন কোনো দোকান ছিলো না যাদের থেকে চা কেনা হয় নি। সবথেকে অদ্ভুত হলো, কোনো দোকানের চা ই দুমাসের পরে আগের স্বাদ, গন্ধ ধরে রাখেনি বা রাখতে পারে নি। তবু, ভালো চা খাওয়ার বিরাম নেই, সেটা যেন মাসের নুন, তেল, ডাল আর মশলার মতোই অপরিহার্য্য। হয় সেটা বাড়িতে বানানো চা নাহলে দক্ষিণাপণে ডলি বসুর টি-পার্লারের হাজার ভ্যারাইটির চা।
তখনও গরিবের একতলা বাড়িতে ফার্স্ট ফ্লাশ, মাসকাটেল বা সেকেন্ড ফ্লাশের আগমন হয় নি; castleton, rohini শুধু নামেই শোনা। একদিন দুই বন্ধুতে ঠিক হলো, শহরের সব পাঁচ-সাত তারা হোটেলে আর কিছু না খেতে পারি, এক কাপ চা তো খেয়ে আসতেই পারি। সেই যে বেরিয়ে পড়েছিলাম দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু মিলে এখনো গত মাসেই আমাদের বন্ধুত্বের কুড়ি বছর পালন করলাম দুটো পরিবার মিলে ওই চা খেয়েই।
এমন ভাবেই ভালোমন্দ চা খেয়ে দিন কাটছিলো যতদিন না অগ্রজ দাদা এক নতুন খনির সন্ধান দিলেন। তাঁর বানানো চা সত্যিই অসাধারণ ততটাই সেই মানুষটি যিনি তাঁকে এই চা সাপ্লাই করেন। ব্যাস – দুয়ে দুয়ে পাঁচ করে নিয়ে আমিও লেজ ধরে ফেললাম। ফল? বিগত দশ বছরের বেশি আমি ফার্স্ট ফ্লাশ চা ছাড়া খুব একটা মুখে তুলি না, আর দার্জিলিং এর মাসকাটেল হলে তো আমি সারাদিন ওটা নিয়েই থাকতে রাজি আছি। খুব কাছাকাছি থাকবে গোপালধারার প্রত্যেকটা চা।
সেদিন সন্ধ্যেবেলা আপন মনে হাটতে হাটতে হটাৎ করেই রাস্তার ধরে একটা ছোট্ট ক্যাফেতে পেয়ে গেলাম এই ফার্স্ট ফ্লাশ। অপূর্ব স্বাদ, কোনো compromise করা নেই। নাহলে আমার মতো ছেলে এক পট চা খেয়ে নিলো একটুও চিনি না মিশিয়ে! ভাবতে পারেন? চায়ের কি মহিমা, বাবা!!