রবীন্দ্রনাথ আর কখনও ফিরে আসেন নি

যখন পড়াশোনাতে বেশিদূর এগোতে পারলাম না, তখন একদিন কুঠিঘাটে গঙ্গার ধারে বসে ভাবছিলাম – কেন এমন হলো? এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না! পড়াশোনাকে আমি যথেষ্ট ভালোবাসি আর সেটার কতটা দরকার সেটাও ভালো মতন জানি। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে, আমি কোনোদিন পড়াশোনাকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে পারিনি। হয়তো আমার বাবা এটার জন্য দায়ী, কোনোদিন আমায় বলেনি যে পড়াশোনা করা আর যুদ্ধ করা একই জিনিস। বললে কি হতো জানি না, তবে আমার কাছে ছোটবেলায় মাঠে খেলতে যাওয়া যেমন একটা কাজ ছিল, রোজ এক ঘন্টা তবলা বাজানো যেমন আবশ্যিক ছিল, তেমনি নিয়ম করে সকালে আর সন্ধ্যেতে এক-দু ঘন্টা করে পড়তাম। ব্যাস. এর বেশি আর কিছু ছিল না।

অনেক ভেবে উত্তর পেয়েছিলাম, কেন আমার দ্বারা পড়াশোনা হলো না। আজ ঠিক করলাম, সেটাই বলি – তাহলে অনেকের ভবিষ্যৎ আমার মতো না হয়ে হয়তো ঠিক দিকে যাবে।

বাঙালি বাড়িতে তিনজনের ছবি একদম must ছিল আমাদের ছোটবেলায় – রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি আর বিবেকাননন্দ। এমন কোনো বাড়ি পাওয়া যাবে না যেখানে এই ছবিগুলো দেওয়ালে টাঙানো থাকতো না। এর সাথে তো তেত্রিশ কোটি দেবতা ছিলই। আমার বাড়িতে অবশ্য ঠাকুরের থেকে মনীষীরা সংখ্যায় বেশি ছিল, যাই হোক।

ঠিক তেমনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। যেহেতু গুরুদেব, তাই সবার স্থান যদি দেওয়ালে হয় তবে তাঁর স্থান ছিল মেঝেতেই। ওই বলে না larger than life, আমাদের রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তেমনি. কালো আলখাল্লা না জোব্বা কি যেন বলে, সাথে সাদা দাড়ি – কি কম্বিনেশন! হাইট ছিল পাঁচ কি ছয় ফুট, আসলের মতোই একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকতেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ।

এবার আসল কথায় আসি। আমি তখন বেশ ছোট। বিকেল হলেই মাঠে খেলতে যাওয়া আমার চাই ই চাই – সে বর্ষার দিন হোক বা শীতকাল! এরকমই কোনো এক বর্ষার দিনে মাঠে গিয়ে দেখি, কেউ আসেনি খেলতে। একটু অপেক্ষা করে একরাশ মন খারাপ নিয়ে চলে এলাম বাড়ি। এসে সোজা তিনতলার ছাদ আর ছাদ লাগোয়া ঘরে। একা একাই ফুটবল খেলবো। ছাদে দাঁড়িয়ে বল মারা হবে আর গোলপোস্ট হবে ঘরের সামনের বারান্দাটা।

বাঁকুড়া থেকে আনা দুটো বড়ো কালো ঘোড়া (সাথে লম্বা কান, সব মিলিয়ে ফুট তিনেক) দিয়ে তৈরী হলো বারপোস্ট. এবার চাই একজন গোলকিপার। কে হবে সেই ব্যক্তি যিনি আমার পেনাল্টিগুলো মুখ বুঁজে সহ্য করবেন? অনেক ভেবে টেনে নিয়ে এলাম ওই পাঁচ ফুটের রবি ঠাকুরকে। বসিয়ে (মানে দাঁড় করিয়ে) দিলাম ওই দুটো বাঁকুড়ার ঘোড়ার ঠিক মাঝখানে!

এবার আমি চলে গেলাম ছাদে, পেনাল্টি স্পট এ – সাথে চামড়ার ছোট একটা ফুটবল। বসিয়ে মারলাম – আজ মনে আছে প্রথম শট গোলপোস্টের কিছুটা বাইরে দেওয়ালে আছড়ে পড়েছিল। পরের শট – রবীন্দ্রনাথ আর বাঁকুড়ার মাঝখান দিয়ে গোওওল!!! আমিও পারি গোল দিতে। সগর্বে পরের বার বলে লাথি মারলাম বেশ জোরে, কনফিডেন্স এসে গেছে। বলটা সোজা লাগলো বার পোস্টে। মাঠে পোস্টে লেগে বল ফিরে আসে, এখানে একটা ঘোড়ার মাথা ভেঙে বলটা অনুশোচনায় ওখানেই পরে থাকলো। ছুটে গিয়ে ঘোড়ার ক্ষতি দেখার আগে সিঁড়ি দিয়ে দেখে নিলাম মা’র কাছে নিচে শব্দ পৌঁছেছে কিনা। কোনো সাড়াশব্দ নেই দেখে আস্বস্ত হয়ে আবার গোল করার দিকে মন দিলাম। একদিকে গোটা একটা ঘোড়া, অন্যদিকে মাথা বিহীন আর একটা। এবারের শটটা মেরে খুব আনন্দ হলো, আমার গায়ে (মানে পায়ে) এতো জোর আছে!

আরো একটা শট।

তারপরে আর কিছু মনে নেই। যখন সব কিছু মনে পড়া শুরু হলো, তখন দেখলাম আমি দোতলার ঘরে বিছানায় বসে আছি। সামনে মা বসে, মোটেই হাসিমুখে নয়। কিছু জিজ্ঞেস করতে হয়নি – নিজের কানেই সব শুনতে পেয়েছি। আমার ওই রোভার্সের রয় এর গোলার মতো শট রবি ঠাকুর বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন, তবে নিজের বিনিময়ে! ওই পাঁচ ফুট কাঁচ ভেঙে গুড়োগুড়ো হয়ে গেছিলো আর ঠাকুরমশাইও ভূমি(কাঁচ)সজ্জা নিয়েছিলেন।

ফোটোটাও ছিঁড়ে গেছিলো, কাঁচও সব ভেঙে গেছিলো – তাই রবীন্দ্রনাথ আর কোনোদিন স্বমহিমায় ফিরে আসেন নি আমাদের বাড়ি। আমারও পড়াশোনার ভবিষ্যৎ সেইদিনই হয়তো নির্ধারিত হয়ে গেছিলো!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.