লেখার কথা ছিলো এটা ইংরেজিতে, ফরমায়েশটা সেরকমই ছিল। শুরুও করেছিলাম সেইভাবেই কিন্তু বাধ সাধলো নিজের মনটাই। একদিকে ইংরেজীতে লিখলে অনেকের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ সাথে অনেককেই বিষয় সম্বন্ধে অবহিত করা আর অন্যদিকে নিজেদের বাঙালীর সরস্বতী পুজোর ট্র্যাডিশন ধরে রাখা।
তাই, কষ্ট হলেও দুই ভাষাতেই থাক – একটা অন্যদের জন্যে আর এইটা শুধুই আমার!
সরস্বতী কিসের দেবী? বিদ্যার নাকি সংগীতের? এইদুটো তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু এটা জানেন কি যে সরস্বতী জ্ঞান, কলা আর শিক্ষার সাথে সাথে বহমান নদী আর ধনসম্পদ প্রাচুর্যেরও দেবী? লক্ষ্মী আর পার্বতীর সাথে উচ্চারিত হওয়া সরস্বতী কিন্তু গোটা দেশেই পূজিত হন বিভিন্ন রূপে।
ঋকবেদে সরস্বতীর উল্লেখ আছে সেটা আমরা সবাই প্রায় জানি, কিন্তু জৈন আর বুদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যেও দেবী সমান জনপ্রিয় সেটা বোধহয় আমরা সবাই জানি না। ভারতের বাইরে যদি বলেন তাহলে নেপালে, চিনে, জাপানে, বার্মাতে এমনকি থাইল্যান্ডেও সরস্বতী আছেন বিভিন্ন নামে।
আজ নাহয় সরস্বতীর অন্য দিকগুলো নিয়ে একটু আলোচনা হোক।
শ্রীকৃষ্ণের ১০৮ টা নাম নিয়ে তো অনেক কিছু বর্তমান, জানেন কি সরস্বতীর নামও নেহাত কম নেই? বাণী, অম্বিকা, ব্রাহ্মী, বচি, হংসসনা আর ভারাদির উল্লেখ তো অনেক জায়গাতেই আছে তবে ভারতী, চন্দ্রিকা, গোমতী, সৌদামিনী, শেতাম্বরা, সুভদ্রা, শতরূপা, সাবিত্রী, বৈষ্ণবী, বসুধা, সারদা, বিন্ধ্যবাসিনী নামও কিন্তু পাওয়া যায় অনেক জায়গায়।ভেবেছিলেন কখনও?
অদ্ভুতভাবে, রামায়ণ আর মহাভারতের মতো ইতিহাসে সরস্বতী আছেন স্বমহিমায়। মহাভারতে সরস্বতী নদীর উল্লেখ ছাড়াও শান্তি পর্বে তাঁকে সব বেদের ঊর্ধ্বে এমনকি ব্রহ্মার পত্নী হিসেবেও উল্লেখ আছে। রামায়ণে যখন রাবণ, বিভীষণ আর কুম্ভকর্ণ তপস্যায় বসেছিল (মতান্তরে একা কুম্ভকর্ণ) ব্রহ্মার বর পাওয়ার আশায় সেখানে কথিত আছে বাকিদের অনুরোধে আর ব্রহ্মার নির্দেশে দেবী কুম্ভকর্ণের মধ্যে ঢুকে তাকে দিয়ে অনন্ত ঘুমের বর চাইয়ে নিয়েছিলেন। সত্যি মিথ্যে জানি না, লোকে তাই বলে। ঠিক যেমন কথিত আছে, ব্রহ্মা আর সরস্বতীর সন্তান হলেন মনু, যার হাত ধরে আমাদের সৃষ্টি।
কথাপ্রসঙ্গে সেদিন একজন বললেন যে পুরাণে সরস্বতীর অনেক কিছু বলা আছে, কিন্তু আমি পুরাণ পড়িনি; তাই সেটা নিয়ে কিছু আলোকপাতও করতে পারবো না। আমার বিদ্যে কিছুটা শোনা আর বাকিটা এদিকে ওদিকে বিভিন্নসময়ে পড়ার মধ্যেই সীমিত।
যে পূর্ব ভারতে সরস্বতী পুজো একটা অন্য মাত্রা পায় সেখানেই সরস্বতীর মন্দির প্রায় চোখেই পরে না। বরং অনেক বেশি জনপ্রিয় দক্ষিণে গোদাবরী নদীর তীরের সরস্বতী মন্দির বা মেদকের দুটো মন্দির। দক্ষিণ ভারতে এছাড়াও কর্নাটকে আর তামিলনাড়ুতে অনেক সরস্বতী মন্দির আছে। গুজরাট, হিমাচল, রাজস্থানও এর ব্যতিক্রম নয়।
তামিলনাড়ু আর কেরালাতে দেখেছি, নবরাত্রির শেষ তিন দিন – অষ্টমী, নবমী আর দশমীতে সরস্বতী পুজো হয়। আমাদের বাংলায় সাথে ওডিশা, ত্রিপুরা আর আসামে সেটা হয় মাঘ মাসের বসন্ত পঞ্চমীতে। শুনেছি গোয়াতেও চারদিন ধরে ধুমধাম করে সরস্বতী পুজো হয় আর তার সাথে বেশ বড়ো আকারের বিসর্জন, অনেকটা গনেশ পুজোর মতন।
এ তো গেল ভারতের কথা, এবার চলুন একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি। ইন্দোনেশিয়াতে সরস্বতী পুজোর দিন পড়াশোনা করতে নেই, কিছু মিল পাচ্ছেন কি আমাদের সাথে? কম্বোডিয়াতে তো ব্রহ্মার থেকে তাঁর সহধর্মিনী সরস্বতীর কদর বেশি। বৌদ্ধ আর জৈন ধর্মশাস্ত্রেও সরস্বতীর উল্লেখ আছে যদিও আমার পড়া নেই সেটা।
বাংলায় সবাই দেবী সরস্বতীকে হাঁসের ওপর অধিষ্ঠিত দেখেন, তাই এই লেখার একমাত্র ছবিটা একটু অন্যরকম – দেবী সরস্বতী অধিষ্ঠিত এক ড্রাগনের ওপরে!
“সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যেকমললোচনে,
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহি নমস্তুতে।
জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুকতাহারে।
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।
নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ।।
এস সচন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।”
দেবী সরস্বতীর ব্যাপ্তি বিশাল, সীমিত পরিসরে তাঁকে ধরার চেষ্টাও করিনি। এটা শুধুমাত্র একটা আলোককণা যা ভবিষ্যতে স্ফুলিঙ্গের জন্ম দিলেও দিতে পারে।