সুমন ধরতাই দিয়েছিলেন অনেক বছর আগে – ‘এ শহর জানে আমার প্রথম সব কিছু’
সত্যিই তো জানে, আর এটা তো সত্যি যে প্রথম সব কিছুর স্বাদ একটু অন্যরকম হবেই। প্রথম স্কুলে যাওয়ার ওই খাকি ব্যাগ যেটা পিঠে নিয়ে নার্সারীতে ভর্তি হয়েছিলাম জাগৃতিতে, সেই ব্যাগটা বহু বছর ছিল বাড়িতে। তাকিয়ে থাকতাম অপলক দৃষ্টিতে পরে। জলের বোতল গলায় না ঝুলিয়ে হাতে করে দোলাতে দোলাতে নিয়ে যেতাম। বাবা দিয়ে আসতো আর মা নিয়ে আসত। বাড়ির কাছাকাছি, তাই প্রথম হাঁটার অভ্যেসটাও ওখান থেকেই চলে এলো।
ছোটবেলায় মারধোর খায় নি এমন ছেলে অনেক আছে, আমিও সেই দলে পড়ি। প্রথম মার খাই অ্যালুমিনিয়াম এর মগ দিয়ে মাথায় আর হাতের লেখা খারাপ হওয়ায় দেওয়ালে মাথা ঠুকে দিয়েছিলো একবার। আর তো এমন কোনো স্মৃতি মনে পড়ে না। প্রথম সিনেমা স্কুল থেকে নিয়ে গেছিল জয়শ্রীতে, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন। নাড়া দিয়েছিল, কে জানতো তার পর কত শত সিনেমা দেখব বাকি জীবনে। তবু আজও ওই সিনেমার বেশ কিছু দৃশ্য চোখে ভাসে।
গান বাজনা ভালোবাসার কারণে অনেক জ্ঞানী গুণী মানুষদের অনুষ্ঠান দেখেছি সামনে বসে, সেটা গোটা সন্ধ্যে জুড়ে হোক বা সারা দিন এমনকি সারা রাত ধরেও। লিস্টে বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেব থেকে আমজাদ আলী আছেন, মান্না দে থেকে আরতি মুখার্জী। কিন্তু প্রথম জলসা দেখি বাড়ির জানলা দিয়ে! বাড়ির পাশে একটা বড় ফাঁকা জায়গা ছিল, সারা বছর আগাছায় ভর্তি – শীতকালে শুধু ঝোপঝাড় কেটে স্টেজ বানানো হতো; পরে যেটার চলতি নাম হয় ‘মাচা’। ঘরের জানালার ব্যালকনি সীটে দাঁড়িয়ে প্রথম শুনি কার্তিক কুমার আর বসন্ত কুমারের গান, খুব হিট হতো ওদের গানগুলো তখন। ওখানেই আগে পরে গেয়ে গেছেন আমার দাদুর বন্ধু পশুপতি দাদুর ছেলে আর বাবার ছাত্র কেদার ভট্টাচার্য; কুমার সানু হয়ে যে বোম্বে দাপাবে পরে।
প্রথম ফাংশন করি যখন ক্লাস ফোরে পড়ি। তবলার মাস্টারমশাই একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করলেন রংমহল থিয়েটার হলে। থিয়েটার তখন পরতির দিকে, স্টার বন্ধ, রঙ্গনা আর সরকারিনাও ধুঁকছে; রংমহল কোনোরকমে হল ভাড়া দিয়ে টিকে আছে। যাই হোক, মূলত বড়রাই বাজাবে যারা অনেকদিন ধরে তবলা শিখছে। আমার দায়িত্ব ছিল সবার তবলা-বাঁয়া বিড়ে সমেত রেডি করে রাখা। অনুষ্ঠানের চার-পাঁচ দিন আগে হঠাৎ মাস্টারমশাই বললেন, তুই একটা গোটা লহরা বাজাতে পারবি একা? সাত পাঁচ না ভেবে বলে দিলাম, হ্যাঁ, পারবো। শুরু হলো দিনে চারবার রেওয়াজ, জীবনের প্রথম ফাংশান বলে কথা; তাও আবার একক। মাস্টারমশায় হারমোনিয়াম বাজিয়েছিলেন আমার প্রথম প্রোগ্রামে, আমি ঠেকা, পেশকার, কায়দা, টুকরা, মুখরা, তেহাই এর বোলগুলো যে কি বাজিয়েছিলাম জানি না, তবে সবগুলো সমে এসে না মিললেও বাচ্চা ছেলেটাকে হাততালি দিতে কুন্ঠিত হয়নি হল ভর্তি লোকজন। সবার সামনে দাঁড়ানোর সাহস বোধহয় সেদিনই পেয়ে গেছিলাম।
প্রথম যেদিন টিভির লাইভ শোতে যাই তখন মোটামুটি বড় হয়েছি। অনেকেই সাবধান করে দিয়েছিলো; বলেছিলো লাইভ প্রোগ্রামে retake এর কোনো জায়গা নেই। সেই ছোটবেলার সাহসে ভর করেই হয়তো উৎরে গেছিলাম সেই দিন, ছাত্ররা ভবিষ্যতে কোন দিকে যাবে তার কিছু সম্ভাব্য রাস্তা হয়তো দেখতে পেরেছিলাম ওই দিনের অনুষ্ঠানে।
আরো অনেক প্রথম থাকে জীবনে, সব মনে রাখা সম্ভব নয়। স্কুল শেষে অনেক বছর পরে হওয়া স্কুলের প্রথম পুরস্কার বিতরণীর অনুষ্ঠানে ক্লাস সিক্স থেকে মাধ্যমিক অব্দি প্রথম হওয়ার সুবাদে একসাথে পাওয়া অনেক অনেক বই আজও রাখা আছে বাড়িতে; সেই প্রথম অতগুলো বই একসাথে হাতে পেয়েছিলাম। প্রথম ভালোলাগার গল্পও বেশ মজার – মর্নিং এর ফার্স্ট গার্ল ডে সেক্শনের ফার্স্ট বয়ের উদ্দেশ্যে ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে রেখেছিলো জনপ্রিয় একটা গানের কিছু লাইন:
হতাম যদি তোতা পাখি
তোমায় গান শোনাতাম,
হতাম যদি বন ময়ূরী
তোমায় নাচ দেখাতাম ।
ভালোবাসার রাস্তা ধরে অনেক এসেছে এই ছোট্ট জীবনে, কিন্তু ওই গানটা আজও ভুলিনি।
ঠিক তেমনি প্রথম একা একা প্লেনে চড়া, প্রথম প্রেম, প্রথম নাটক দেখা, প্রথম চাকরী, প্রথম মা – বাবাকে ছাড়া একা রাত কাটানো, প্রথম কর্পোরেট ডকুমেন্টারিতে বক্তব্য রাখার সেই সব মুহূর্তগুলো কি আর ভোলা যায়? আরো অনেক প্রথম হয়তো লুকিয়ে আছে কোণায় কোণায়, আপাতত এইগুলোই মনে পড়লো প্রথমে।