গ্রহণের গেরো

হিন্দু শাস্ত্রের গলাকাটা রাহুর সূর্যকে গিলে ফেলা, আবার নীচ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার গল্প তো আমরা সবাই জানি। আমাদের দেশে সূর্য গ্রহণের এটাই আদি ব্যাখ্যা। ঠিক যেমন কোপারনিকাস, ব্রুনো, গ্যালিলিওরা বলার আগে অব্দি আমরা জানতাম সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, সকালে পূর্ব দিকে ওঠে আর বিকেলে পশ্চিমে অস্ত যায়। বিজ্ঞানের পা মাটিতে পড়ার আগে এই ধারণা নিয়েই আমাদের চলতে হতো, শুধু ভারত কেন গোটা বিশ্ব জুড়েই ছিল কিছু অলীক কল্পনা যা হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ বিশ্বাস করে আসছে।

সূর্যগ্রহণ নিয়ে বলছিলাম, ওটা নিয়েই বলব আজ। পুরোটাই স্মৃতি থেকে টেনে আনা বিভিন্ন সময়ে নানারকম বই পড়ার মাধ্যমে আহরিত জ্ঞান, আমি শুধু জাল বুনে যাওয়ার কাজটা করি।

এই যে চিনের সাথে আমাদের একটা Love – Hate সম্পর্ক, সেই চীনারা কিন্তু বিশ্বাস করে যে সূর্য হল ড্রাগনের দুপুরের খাবার। যেদিন খেয়ে ফেলে সেদিন গ্রহণ হয়। একটু দূরে ‘তোমার নাম আমার নাম’ ভিয়েতনাম এই সেদিনও বিশ্বাস করত যে একটা বড় ব্যাঙ সূর্যকে গিলে ফেলে। কেউ কেউ আরো এক ধাপ এগিয়ে বলে একটা নেকড়ে নাকি সূর্যকে খেয়ে নিলে সেদিন সূর্যগ্রহণ। যে কোরিয়া আজ বিজ্ঞানে সবচেয়ে উন্নত, তাদের পূর্ব পুরুষরা কিন্তু বিশ্বাস করত যে একটা কুকুর যখন সূর্যকে চুরি করে নিয়ে যায় সেই সময়টাতেই সূর্যগ্রহণ হয়। কিছুক্ষণ পরে সূর্য তার অমিত বিক্রমে বেরিয়ে এসে আবার আমাদের সবাইকে আলো দেয়। একটা জিনিস খেয়াল করবেন, সব ক্ষেত্রেই একটা জন্তু কিন্তু সূর্যগ্রহণের মূল ধারক। তাই এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সূর্যগ্রহণের সময় থালা বাটি বাজিয়ে ওই প্রাণীটিকে তাড়ানোর একটা প্রচেষ্টা করা হতো। প্রবল পরাক্রমশালী মানুষের কাছে তাই অবশেষে হার মানতে হতো ড্রাগন, ব্যাঙ, নেকড়ে অথবা কুকুরকে। গ্রহণও কেটে যেত যথা সময়ে।

একটু পশ্চিমে তাকানো যাক। জনজাতি বা উপজাতি যাই বলি, তাদের বিশ্বাস ছিল একটা ভালুক সূর্যের সাথে খুব যুদ্ধ করে এক খাবলা কামড়ে নেয়। এর পর ভালুকের নজর পরে চাঁদের দিকে। আধ খাওয়া চাঁদই পরে চন্দ্র গ্রহণ নামে প্রচলিত হবে। অনেক দিন অব্দি সূর্যগ্রহণ এর পরপরেই চন্দ্রগ্রহণ হওয়ার এটাই ছিল যুক্তি তাদের কাছে। আর এক দল বিশ্বাস করতো সূর্যদেব রেগে গিয়ে যখন নিজের বাড়ি চলে যান তখনই সূর্যগ্রহণ হয়। এর পরেই শুরু হয় পৃথিবী জুড়ে ধ্বংসলীলা।

এস্কিমোরা বাসনপত্র উল্টে রাখে যাতে খারাপ কিছু না পড়তে পারে, আফ্রিকার লোকেরা খোলা জায়গায় এসে প্রার্থনা করে সূর্যের ওপর ছায়া যেন সরে যায় ।

ভারতের কথা শুনবেন? কেরালার কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন সূর্যগ্রহণ আসলে পৃথিবীর ওপর অনেক অত্যাচারের ফল। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণে সেই ধার বাকি পুরো শোধ হয়ে যায়, আংশিক হলে কিছু পাপ থেকে যায়। মধ্য ভারতেও একদল লোক গ্রহণকে পাপের ফল বলে মনে করে। অসমিয়াদের মতে গ্রহণ হল অশুভ শক্তির বিনাশ।

একটা মজার গল্প মনে পড়লো, সূর্য আর চাঁদ নাকি একবার নিজেদের মধ্যে মারামারি করে একে অন্যকে আহত করে। গ্রহণ আসলে সূর্য বা চাঁদের ওই অর্ধেক রূপ। আধখাওয়া আপেল এর ছবিটা মনে পড়ছে? সেই কোম্পানিতে কিন্তু গ্রহণ লাগেনি, বহাল তবিয়তে চলছে সে।

আমরা আজও বিশ্বাস করি গ্রহণের সময়ে রান্না করতে নেই, কিছু খেতে নেই, বাইরে বেরোতে নেই। অথচ মিশরের রাজা সূর্যগ্রহণের দিনে গোটা রাজ্য ঘুরে সবাইকে আশ্বস্ত করতেন। কেন ইতালির মানুষদের মতো আমরা ভাবতে পারি না যে গ্রহণের সময়ে একটা ফুলগাছ পুঁতলে সেই গাছটা খুব শুভ, সেই গাছের ফুল বাকি সব গাছের থেকে অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.