হাফ সোলের গপ্পো

কুটিঘাটের ডাচ সাহেবের পোড়ো বাড়ির শেষকোণে সবচেয়ে মিষ্টি আম গাছটার মগডালে তখন আমি। হঠাৎ দেখি কে যেন আসছে – মুখে তখন একটা আধ-খাওয়া আম আর বাঁ হাতে একটা গোটা ধরা। পড়ি কি মরি করে লাফ দিয়ে নিচে নেমে চটি পরে দে-দৌড়। কাঁটাগাছ, শুকনো পাতা, আগাছা পেরিয়ে পাঁচিল যেই টপকেছি, পিঠে কি একটা এসে পড়লো। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, আমারই চটির অর্ধেকটা। এক পায়ে চটি আর আর এক হাতে ওই হাফ সোল নিয়ে কার্ল লুইস এর স্পিডে বাড়ি এসেছিলাম। সেই প্রথম আমার হাফ সোল এর অভিজ্ঞতা।

এর পরে হাফ সোল নানা ভাবে এসেছে জীবনে – কৈশোর আর যৌবনে। এক এক বার তার এক এক রূপ! শেষ দিয়েই শুরু করি – এই তো সেদিন মেট্রো থেকে নামতেই অর্ধেক সোল গেলো খুলে। জুতোকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, তার রক্ষণাবেক্ষণ না করলে এটা অবশ্যম্ভাবী। একটা জুতো পরে বিশ্বজয় সম্ভবত আলেক্সান্ডারও দেখেন নি! ব্যাঙ্গালোরের রাস্তায় কলকাতার মত জুতো সারাইওয়ালার দেখা পাওয়া আর পারিসে গরুর দুধ পাওয়া একই ব্যাপার। অগত্যা নতুন জুতো পরে অফিস।

মুখে বলব রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি অথচ পিঠে চ্যালা কাঠ ভাঙ্গেনি বা হাফ সোলের মার খায়নি এমন বাঙালি মেলা দুষ্কর! আমিই বা বাদ যাই কেনো এই লিস্ট থেকে। সবার সামনে দিনে দুপুরে যখন রামুকাকা কান ধরে রাস্তায় ফেলে জুতোপেটা করেছিলো, তখনও তো জুতোর শুকতলা খুলে গেছিল। অপরাধ করেছিলাম, সাইকেল চালানো শিখতে গিয়ে সোজা ওনাদের বাঁশের বেড়ার গেট ভেঙে দিয়েছিলাম। বেশি কিছু না, মাচার ওপরের বেশ কিছু শশা, কুমড়ো আর মাটিতে হতে থাকা টমেটো গাছগুলো সব শেষ হয়ে গেছিলো। তার জন্যে এই শাস্তি! ছি! ছি!

তাহলে শুনুন, হাফ সোলের কাহিনী। আমার অশতিপর দাদু পুরোনো সব কিছু সংগ্রহ করে রাখতে ভালোবাসতেন। সে সাবেক কালের গড়গড়া হোক বা লোহার হারিকেন। বাদ যায় না গ্যাসের পাইপ থেকে না চলা ঘড়ি পর্যন্ত। যুক্তি বড় অদ্ভুত, বাড়ির কিছু প্রয়োজন হলে নাকি ওখান থেকে বিপদে আপদে ব্যবহার করা যাবে। এ যেন বাগানে হওয়া লঙ্কা, রান্না করতে করতে কম পড়েছে বলে তুলে আনো। দাদুর সেই সংগ্রহ থেকে একটা না-চলা জাহাজ কম্পাস চুরি করে যা জুতোর বাড়ি খেয়েছিলাম, জুতো তো অক্ষত ছিলই না, উল্টে হাফ সোলের মার খেয়ে খেয়ে আমার পিঠটা বেশ শক্ত হয়ে গেছিল।

চিনে জিনিসের ওপর আমাদের ঝোঁক আজ নতুন নয়। বাঙালি হয়ে আপনি যদি চীনা বাজারের জুতো একবার না পড়েছেন – তাহলে জীবন বৃথা। সে জুতো টিকুক আর না টিকুক, ফুল বা হাফ সোল খুলে হাতে আসুক বা না আসুক, ওই জুতোয় আমি আপনি দাদা একবার পা গলাতে বাধ্য। মনে পরে দেওয়ালে সারি সারি জুতো সাজানো আর সেটাও যথেষ্ট সস্তায়। কারণ একটাই, ওই জুতোগুলোর সোল হত ছাঁটের মাল দিয়ে। যথারীতি সেগুলোর আয়ু হত কয়েকটা দিন আর তারপরে স্থান হত নতুন কোনও বাড়ীর ছাদের লাঠির আগায়।

হাফ সোলের গল্প শেষ করবো একটা মজার ঘটনা দিয়ে। কলেজ জীবনে ক্ষয়ে যাওয়া সোলের ওপর আলাদা করে হাফ সোল লাগিয়ে বেরিয়েছি দুর্গা পুজোর ঠাকুর দেখতে। সাথে বেশ কিছু বন্ধু আর হঠাৎ জুটে যাওয়া কিছু বান্ধবী। অষ্টমীর রাত, কলেজ স্কোয়ারের ঠাকুর দেখতে গিয়ে প্রথমে বান্ধবীরা ছিটকে চলে গেলো অন্য দিকে ভিড়ের চাপে আর একটু পরেই আমি আবিষ্কার করলাম যে বাঁ পা টা কেমন হালকা হালকা লাগছে! একটু পরে বুঝলাম আমার বাম পা টি মাটির বড্ড বেশি কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। নতুন লাগানো হাফ সোল খুলে গিয়ে ডেনড্রাইট এর হালকা গন্ধ আসছে। একদিকে বান্ধবীদেরও হারালাম অন্যদিকে পুজোর আনন্দ মাটি করে শুকনো মুখে বসে থাকলাম।

তার পর থেকে আজ অব্দি ফ্রি তে দিলেও হাফ সোলের রাস্তা আর কোনোদিন মারাই নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.