হারান মাস্টারের পাঠশালা

জেলার শেষপ্রান্তে এই বন্দিপুর রোড স্টেশন। লোকজনের খুব একটা যাতায়াত নেই এই রেললাইনে। কিন্তু কাছেই পলাশবীথি হাট বসে বলে দুটো মালগাড়ি দিনে থামে এখানে, একটা সকালে আর একটা মাঝরাতে। এই দু’বার বাইরে বেরিয়ে সবুজ পতাকা নাড়ানো ছাড়া স্টেশন মাস্টার হারান চন্দ্র মল্লিকের আর কোনো কাজ নেই সারা দিনে। গয়েশডাঙ্গা থেকে বদলি হয়ে আসার সময়েই এটা মনে হয়েছিল হারানের, তবে একলা মানুষ যেভাবেই হোক সময় কাটিয়ে নেবে – এই ধারণায় চলে এসেছিলো এখানে। ভাবতে পারেনি যে এখানে অনাদি বাবু আর যতীন ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া সারাদিন কথা বলার মতো আর কাউকে পাবেন না!

এমনিতে বন্দিপুর গ্রামটা বেশ ভালো, কোনোরকম ঝুট-ঝামেলা নেই। বেশিরভাগ মানুষই চাষবাস করে আর বাকিরা পাশের গ্রামের সাইকেল কারখানায় কাজ করে। পড়াশোনার চল একটু কম, যদিও একটা করে প্রাইমারি আর হাইস্কুল আছে। প্রাইমারির মাস্টার মশাই বেশ রসিক মানুষ, মাঝেমাঝে আসেন আড্ডা দিতে। কিন্তু, হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের দেখা পাওয়া খুব মুশকিল। শহরেই নাকি তিনি বেশি থাকেন, এখানে মাঝেমধ্যে আসেন যদি দরকার পরে।

হারানবাবু এই জায়গাটা মেরামত করতে লেগে গেলেন। এমনিতেই সারাদিন কোনো কাজ নেই দুপুরে ভাত ঘুম দেওয়া ছাড়া। তাই তিনি ঘুরে ঘুরে শুরু করলেন ছাত্র জোগাড় করা। কারখানার মজদুরের ছেলে, পাশের বস্তির অনেকগুলো ছোট বড় ছেলে মেয়ে – এরকম কিছু খুঁজে পাওয়া গেলো যারা স্কুলে যায় না। হারানবাবু লেগে পড়লেন তাদের মানুষ করার কাজে।

চাকর গণেশকে নিয়ে সেদিন দুপুরেই যাওয়া হলো শহরের দিকে। কিছু বই, খাতা, পেন, পেন্সিল কিনতে হবে। পরের দিন থেকে তিনি স্টেশনেই পড়াতে শুরু করবেন বাড়ির চাটাই পেতে। কিন্তু ওপরওয়ালা বোধহয় অন্য কিছু ভাবছিলেন! সেদিন রাতে সবাইকে বাড়ি গিয়ে বলে আসা সত্ত্বেও পরেরদিন সকালে কুমোর রবির ছেলে ছাড়া আর কেউ এলো না! একটু অবাক হলেও ওকে নিয়েই বসে পড়লেন, যদিও একটু পরে সেও মা ডাকছে বলে পালিয়ে গেলো। পরের দু’দিন হারান মাস্টার সব সাজিয়ে বসে আছে, কিন্তু পড়তে আসার কেউ নেই।

তিনদিন পর হটাৎ এলো রানী, সাথে আরো চারজন – মাস্টারজেঠু, আমরা পড়তে এসেছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.