মান্না দের জন্মদিনে

শুনতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে মান্না দের প্রথম গান আমি বাংলায় শুনিনি। বাড়িতে তাঁর একটাই রেকর্ড ছিল সেই সময়ে, যার দুপিঠে একটা করে মোট দুটো গান – একপিঠে ‘লাগা চুনরী মে দাগ’ আর অন্য পিঠে ‘ফুল গেন্ডওযা না মারো’। দুটোই ভৈরবী রাগে আধারিত আর চলনও খুব পরিষ্কার। সেই প্রথম আর বারবার মান্না দে কে শোনা। ওই একটাই রেকর্ড কতবার শুনেছি সত্যিই আজ আর মনে নেই । শুধু এটুকু মনে আছে, ব্ল্যান্ক ক্যাসেট যখন এলো তখন আরো অনেক গানের সাথে মান্না দের যাবতীয় রাগসঙ্গীত নির্ভর গান যা সিনেমাতে ব্যবহার হয়েছিল, সবগুলোকে রেকর্ড করেছিলাম। পরে অবশ্য HMV ক্যাসেটে আকারেই বের করে দিয়েছিলো, সেটা আজও হয়তো খুঁজলে কলকাতার বাড়িতে পাওয়া যাবে।
এই ছিলেন মান্না দে, কিশোর কুমার আর মহম্মদ রফির যুগেও যার স্বাতন্ত্র তাঁকে এক উজ্জ্বল ব্যক্তি বানিয়েছিলো। একের পর এক হিট গান দিয়ে গেছেন হিন্দি সিনেমা আর বাংলা আধুনিকে – কোন গান ছেড়ে কোনটার কথা বলবো? প্রত্যেকটাই এক একটা মাইলস্টোন। এতো গানের নাম লিখতে পারবো না। রাগমালা সিরিজে বলেছিলাম, আমার দাদুর সেই বিখ্যাত গানের খাতার কথা। সেই খাতায় দিকপাল সব শাস্ত্রীয় সংগীতজ্ঞদের সাথে তানপুরা হাতে বসা অবস্থায় মান্না দেরও একটা ছবি ছিল। যে বইয়ের পাতায় পাতায় ওস্তাদ বড় গোলাম আলী খান, আমির খান, কেরামাতুল্লাহ খানরা আছেন, যে বইতে কিশোরে কুমার এমন কি লতা মঙ্গেশকরেরও কোনো ছবি নেই, সেখানে মান্না দে কি রূপে বিরাজ করছেন তা সহজেই অনুমেয়। এই ছিলো ওনার গ্রহণযোগ্যতা। সাধে কি কিশোর থেকে রফি সবাই অম্লানবদনে বলেন যে তাঁরা শুধু মান্না দের গানই শোনেন। এ এক পরম প্রাপ্তি।
তাই বলে কি মান্না দে যা গেয়েছেন, সবই ভালো? আমার ব্যক্তিগতভাবে ওনার রবীন্দ্রসংগীত একদমই ভালো লাগেনি, ঠিক তেমনি অনেকেই ওনার নজরুলগীতি গান শুনে ভুরু কুঁচকেছেন। কিন্তু, এগুলোকে সরিয়ে রেখে যদি বাংলা আধুনিক আর ছায়াছবির গান ধরা হয় তাহলে হিট গানের লিস্ট শেষ হওয়ার নয়। তারপর তো সেই সব বিখ্যাত হিন্দি গানগুলো তো আছেই – কি সোলো বা ডুয়েট! আসমুদ্র হিমাচল মাতিয়ে দিয়েছিল সেই সব গান যা আজও আমাদের কানে বাজে।
মান্না দের জীবনী নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই, সবাই এতদিনে ওনার অনেক কিছুই জানেন। সেই পুরোনো রাস্তা নাহয় আজকের দিনে আর মাড়ালাম না। অনেক দুঃখে কলকাতা ছেড়ে ব্যাঙ্গালোর নিবাসী হয়েও শেষ জীবনটা ভালো কাটেনি এই প্রবাদ প্রতিম শিল্পীর। আত্মজীবনীর প্রতিটা পাতায় সেটা ফুটে ওঠে বারবার, কিন্তু গান গেটে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
শেষ করবো একটা লাইভ শোয়ের ঘটনা বলে। ততদিনে কলকাতায় মান্না দের একক বা বাকি সবার সাথে অনেকগুলো অনুষ্ঠান শোনা হয়ে গেছে। মূলত বাংলা আধুনিক, বাংলা সিনেমা আর হিন্দি সিনেমার গানই হতো এইসব অনুষ্ঠানে। সেবার উত্তর কলকাতায় একটি বিখ্যাত বাড়িতে মান্না দে গান গাইছেন, সারা সন্ধ্যের এবং রাতের মূল আকর্ষণ তিনিই। মূলত রাগসঙ্গীতের সন্ধ্যা – মিলিয়ে মিশিয়ে গান হচ্ছে, কখনো ভজন, কখনো কাওয়ালি আবার কখনো বা নিখাদ ঠুমরি। গানে গানে কখন যে সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে গেছে কারুরই বোধহয় খেয়াল নেই। শুরু করেছিলেন আশাবরী রাগটা একটু ধরে ‘তেরে নয়না তালাশ করে’ দিয়ে আর বলে রেখেছিলেন, সবার শেষে ‘কা কারু সজনী আয়ে না বালম’ ঠুমরি গেয়ে অনুষ্ঠান শেষ করবেন। হাতে গোনা মুষ্টিমেয় কিছু শাস্ত্রীয় সংগীতকে ভালোবাসা মানুষজন উপস্থিত সেখানে। তাল কাটলো হটাৎই যখন একজন অবাঙালি আমন্ত্রিত আবদার করে বসলেন – আপনার ‘ওই এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি’ গানটা হবে না? হয় মান্নাবাবু শুনতে পাননি কিংবা মূল গানের ধারাকে ডিসটার্ব না করার জন্যে হয়তো শুনেও শোনেন নি, তৃতীয় সারিতে বসে সেটা আমার বোধগম্য হয় নি। অনুষ্ঠানের প্রায় শেষের দিকে, মান্নাবাবু সবে রাগেশ্রীতে ‘কৌন আয়া মেরে মন কে দ্বারে’ শেষ করে একটু আদা দেওয়া লাল চা তে চুমুক দিয়েছেন, সেই ভদ্রলোক আবার বলে বসলেন – আমার বিবি বলে দিয়েছে ‘কে প্রথম ভালোবেসেছি’ গান শোনার রিকোয়েস্ট করতে, ওটা কখন শুনতে পাবো?
মান্না দে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন, সেই তাকানোতে বিস্ময় ছিল নাকি রাগ নাকি উভয়ের মিলমিশ সেটা বলতে পারবো না; তবে গোটা সাত – আট ঘন্টার ওই অনুষ্ঠানে একবারের জন্যেও ঐরকম চাউনি দেখিনি আমরা কেউই। কিছু না বলে সোজা উঠে গিয়ে গটগট করে পাশের ঘরে চলে গেলেন, শত অনুরোধেও আর ফিরে এলেন না। আমারও আর ‘কা কারু সজনী আয়ে না বালম’ সামনে বসে শোনাও হলো না কোনোদিন।
জন্মদিনে আমার শ্রদ্ধা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.